ডাঃ ফাতেমা রহমান খান:
মফিজ সাহেবের গলায় একটি ধাতব দাঁত খিলাল ঝুলছে। ঠিক যেমন চেইনে লকেট ঝুলানো থাকে, সেরকম। অনেক বছর আগে রূপা দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলেন শখ করে। খাওয়ার পর দুই দাঁতের ফাঁকে জমে যাওয়া খাবার পরিষ্কার করতে তিনি আজও এর ব্যবহার করে যাচ্ছেন। এ যুগেও যে কেউ এ জিনিস ব্যবহার করতে পারে তা আমার ধারণা ছিল না। দাঁতের এক্স-রে করে যা পেলাম তার সারমর্ম এ লেখার মাঝেই পেয়ে যাবেন।
ধাতব টুথপিক এর ব্যবহার ইদানিং কালে দেখা না গেলেও কাঠের দাঁত খিলাল বা টুথপিক এর এখনও অহরহ ব্যবহার হচ্ছে। মূলত খাওয়ার পর দুই দাঁতের মাঝখানে জমে থাকা খাবার পরিষ্কার করতেই এ টুথপিক ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু অনেকে আবার এতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যে খাওয়ার পর সব দাঁতের ফাকা গুলো খুঁচিয়ে না নিলে স্বস্তি পান না। এ জন্যই এককালে মফিজ সাহেবের মত অনেকেই ধাতব দাঁত খিলাল বানিয়ে নিজের সংগে রেখে দিতেন।
দাঁতখিলাল বা টুথপিক এর ব্যবহার আমাদের দাঁতের জন্য আসলে কতটা উপকারী?
টুথপিকের ব্যবহার আমাদের দাঁত ও মাড়ির উপর কিছু স্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে যা আমরা নিজের অজান্তেই প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি।
১. মাড়ির প্রদাহ- টুথপিকের মাধ্যমে দুই ভাবে মাড়িতে প্রদাহ বা ইনফেকশান হতে পারে। প্রথমত, দুই দাঁতের মধ্যখান পরিষ্কার করার সময় দাঁত খিলালের সূঁচালো প্রান্ত মাড়ির নরম টিস্যুতে আঘাত করতে পারে। এতে ক্ষত তৈরী হয় এবং অনেক সময় রক্ত বের হতে পারে। দ্বিতীয়ত, টুথপিকে থাকতে পারে নানা রকম জীবানু। বিশেষ করে যারা একই টুথপিক একাধিকবার ব্যবহার করেন তাদের ইনফেকশানের ঝুঁকিটা একটু বেশি। এসব জীবানু মুখগহবরে প্রবেশ করে দাঁতের মাড়ি, দাঁতের গোড়া ও মুখের ভেতরের অন্যান্য অংশে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
২. মাড়ির ক্ষয়রোগ ও দাঁত শিরশির করা- প্রতিদিন দাঁতখিলাল ব্যবহার করার ফলে মাড়ির টিস্যুগুল্য দূর্বল হয়ে পড়ে। ফলে দাঁতের যেটুকু অংশ মাড়ি দিয়ে ঢেকে থাকার কথা সেটুকু অনাবৃত হয়ে যায়, অর্থাৎ দাঁতের গোড়া উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ঠান্ডা গরম পানি, খাবার ও বাতাসের সংস্পর্শে এলে দাঁত শিরশির করে৷
৩. দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত হয় - টুথপিক দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করার সময় দাঁতের সবচেয়ে বাইরের আবরণ এনামেল ও দাঁতখিলালের ক্রমাগত ঘর্ষণ হলে এনামেল ক্ষয়ে যেতে পারে।
৪. দাঁতখিলাল ভেংগে দাঁতের ফাকে আটকে যাওয়া- কখনও ভুলবশতঃ দাঁতখিলাল ভেংগে এর ছোট্ট অংশ দুই দাঁতের মাঝখানে আটকে গেলে ব্যাথা ও ইনফেকশান হতে পারে, মাড়ি ফুলে যায়। এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
৫. দুই দাঁতের মাঝখানের দূরত্ব বেড়ে যাওয়া- দীর্ঘদিন টুথপিক ব্যবহারের ফলে দুই দাঁতের মধ্যখানের স্বাভাবিক গ্যাপ টুকু দিনে দিনে বাড়তে থাকে। এতে আরো বেশি খাবার জমতে থাকে এবং ঠিকমত পরিষ্কার করা না হলে দাঁতে ক্যারিজ সহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৬. দাঁতের ফিলিং ভেংগে যাওয়া ও প্রস্থেসিস স্থানচ্যুত হওয়া - দাঁতের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যাদের মুখে ফিলিং করা আছে, দাঁত খিলাল ব্যবহারের কারণে তা ভেংগে যেতে পারে। ক্রাউন ও ব্রিজ বা ব্রেসেস পরানো থাকলে টুথপিক দিয়ে খোঁচানোর ফলে এগুলোর উপর প্রতিনিয়ত চাপ পড়ে এবং একসময় তা দাঁতের থেকে খুলে যেতে পারে।
দুই দাঁতের মধ্যবর্তী স্থান পরিষ্কার করার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল ডেন্টাল ফ্লসের সাহায্যে #ফ্লসিং করা অর্থাৎ দাঁতের জন্য তৈরি সুতার সাহায্যে দুই দাঁতের মাঝখান পরিষ্কার করা। খাওয়ার পর ফ্লসিং করা হলে খাবার জমতে পারেনা, জীবানু সংক্রমণ হয় কম, মুখে দূর্গন্ধ, দাঁতের গোড়ায় পাথর, মাড়ির প্রদাহ ও ডেন্টাল ক্যারিজ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ডাঃ ফাতেমা রহমান খান
সিনিয়র ডেন্টাল সার্জন
লাইফলাইন কন্সাল্টেশান ও ডায়াগনস্টিক লিমিটেড
বসুন্ধরা, ঢাকা