চন্দ্রিকা চক্রবর্তী : ঋতু পরিক্রমায় বছর ঘুরে আবারো এলো পহেলা বৈশাখ। প্রতিটি বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ পহেলা বৈশাখ। বাংলা সনের প্রথম দিনটিকেই আমরা পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ হিসেবে অভিহিত করে থাকি। আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে নববর্ষ। এটি বাঙালির সর্বজনীন লোকউৎসব।
পহেলা বৈশাখ প্রচলিত হওয়ার ইতিকথা বেশ পুরোনো। যতোটুকু জানা যায়, খাজনা আদায় সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হওয়ার লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর সর্বপ্রথম বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। যদিও অনেক ঐতিহাসিক আবার বাংলা দিনপঞ্জি প্রচলনের কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন রাজা শশাঙ্ককে। তবুও আকবরকেই সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সেসময় পহেলা বৈশাখ পালনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো কৃষিনির্ভরতা। "হালখাতা" উৎসবের প্রচলনও তখন হয়েছিল যেটা পুরোপুরি একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। এখনো এদেশের অনেক জায়গায় এই প্রথা চলমান। "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত " ও "পুন্যাহ" প্রথা তখন অধিক জনপ্রিয় ছিলো যা কালের বিবর্তনে এখন বিলুপ্তপ্রায়। অর্থাৎ, পূর্বের এবং বর্তমানের পহেলা বৈশাখ উদযাপনে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়।
নববর্ষের উৎসব গ্রামীণ জীবনের সাথে খুব গভীরভাবে সম্পর্কিত। পল্লী অঞ্চলের বেশ কয়েকটি স্থানে বর্ণাঢ্য মেলা বসে। বিশেষ করে নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। মৃৎশিল্প, কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প, লোকশিল্পসহ আরো অনেক প্রকারের শিল্পজাত সামগ্রী পাওয়া যায় বৈশাখী মেলায়। নানারকম মুখরোচক খাবার পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য এবং চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা প্রধান। এছাড়াও বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান যেমন পালাগান, যাত্রাগান, কবিগান, জারিগান, বাউলগান, ভাটিয়ালি গানসহ আঞ্চলিক গান এবং পুতুলনাচ, নাগরদোলা, নাটক, সার্কাস, বায়স্কোপ ইত্যাদি বৈশাখী মেলার প্রধান আকর্ষণের বিষয়বস্তু। আমাদের দেশে যেসব জায়গায় বৈশাখী মেলা বসে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মহেশপুর, টুঙ্গিপাড়া, মুজিবনগর এলাকা প্রমুখ।
শুধু গ্রামীণ জীবণ নয়, বর্তমানে নগরজীবনেও জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ পালিত হয়। শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে সবাই উৎসবের আনন্দে একাকার হয়ে যায়। ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করার প্রবণতাও এইদিনে বেশ লক্ষ করা যায়। তরুণীদের দেখা মেলে কপালে টিপ, গলায় ফুলের মালা, খোপায় ফুল, হাতে চুড়ি ও লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরা অবস্থায়। তরুণদের দেখা যায় পাজামা-পাঞ্জাবিতে। পান্তা-ইলিশ খাওয়া একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে।
নববর্ষে রমনা উদ্যানে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। প্রথম প্রভাতেই চোখে পড়ে এই জনসমুদ্রের ঢেউ। "ছায়ানটে" প্রতিবার রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান "এসো হে বৈশাখ এসো এসো" এর মাধ্যমে নববর্ষকে বরণ করে। ১৯৬৫ সাল থেকেই এটা হয়ে আসছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি দৃষ্টিনন্দিত অনুষ্ঠান। শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ গ্রহণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট। ১৯৮৯ সাল থেকেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের একটি অন্যতম আকর্ষণ। উপজাতিরা (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) এদিন "বৈসাবি" উৎসব পালন করে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।
নববর্ষে পালিত উৎসবগুলোতে হয়তো স্থানভেদে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। তবে এটা সত্যি যে, প্রতিটি উৎসব পালনের উদ্দেশ্য মূলত একটাই। সেটা হলো পুরোনো দিনের সকল দুঃখ, বিষাদ, গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন করে আনন্দ, উদ্দীপনা নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখা। ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতা ছেড়ে একটি অনবদ্য মিলন উৎসবে মেতে উঠা। আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে পুনরায় জাগ্রত করা। নিজেকে নতুনভাবে, নতুনরুপে আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা। সর্বোপরি, আমাদের জীবনকে নতুনভাবে গ্রহণ করা হোক নববর্ষ পালনের উদ্দেশ্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
সময় জার্নাল/এমআই