মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা:
সাতক্ষীরায় চিংড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মিঠা পানিতে সাদা মাছের চাষ। আর সাদা মাছ চাষ সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে বাড়ছে ঘেরের আইলে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ। চলতি বছর জেলায় ৮৭৫হেক্টর জমির আইলে সবজি চাষ হয়েছে। ঘেরের আইলে সবজি আর নিচে পানিতে মাছ। ক্রমেই বাড়ছে এই চাষ পদ্ধতি। ফলে জেলায় সমন্বিত সবজি চাষে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে।
বেড়ি বাধে সাতক্ষীরার কৃষিস¤প্রসারণ অধিদপ্তরের (ঘামারবাড়ি) প্রচেষ্টায় বিগত কয়েকবছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মাছের ঘেরের বেড়িতে (বাঁধে) সবজি চাষ। ‘সাথী ফসল’ হিসেবে শুরু হলেও এখন মূল ফসলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে সমানে সমান। মাচায় বা ঘেরের আইলে সবজি আর নিচে পানিতে মাছ চাষ হচ্ছে। আর এখানে উৎপাদিত সবজি পুরোটাই বিষমুক্ত। ফলে এর চাহিদাও রয়েছে দেশজুড়ে। জেলায় বছর প্রতি যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ঘেরের আইলে ও মাচা পদ্ধতিতে। ঘেরের আইলে সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় জেলার অধিকাংশ সাদা মাছের ঘেরে সবজির চাষাবাদ দিন দিন বাড়ছে। ফলে জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলায়ও রপ্তানি হচ্ছে সাতক্ষীরার সবজি।
সাতক্ষীরা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর (খামারবাড়ি) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলার ৮৭৫ হেক্টর জমির (মাছের ঘেরের বেড়ি) আইলে বিভিন্ন প্রকারের সবজি চাষ হয়েছে। এবার সবচেয়ে বেশি সবজির চাষ হয়েছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় আর সবচেয়ে কম চাষ হয়েছে দেবহাটা উপজেলার মাছের ঘেরের আইলে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ৩৪০ হেক্টর জমির আইলে সবজি চাষ হয়েছে, তালায় ১৬৫ হেক্টর, কলারোয়ার ৫৫ হেক্টর, আশাশুনি ৮০ হেক্টর, কালিগঞ্জে ১৩৫ হেক্টর, দেবহাটায় ২০ হেক্টর, ও শ্যামনগর উপজেলার ৮০ হেক্টর জমির আইলে সবজির চাষ হয়েছে। জেলার মোট চাষকৃত মাছের ঘেরের জমির আইলে হেক্টর প্রতি গড় ১৯ মেট্রিকটন হারে মোট ১৬ হাজার ৬২৫ মেট্রিকটন সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ।
জানা যায়, মাছের ঘেরের আইলে বিশেষ পদ্ধতিতে বাঁশ ও জাল দিয়ে ঝুলন্ত মাচা তৈরি করা হয়। তারপর বিষমুক্ত সবজির আবাদ করে বাড়ন্ত গাছ মাচার ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে জায়গা কম লাগে ও অল্প পরিচর্যায় ভালো ফসল পাওয়া যায়। মৌসুমী ধান ও মাছ চাষ করে একসময় যাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটত, লাভজনক সমন্বিত সবজি চাষে এখন তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। ‘অল্প পুঁজিতে অনেক লাভের ফলে উৎসাহিত হয়ে এখন সমন্বিত এই চাষের দিকে ঝুঁকছেন
অনেকেই।
জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ মৎস্য ঘেরগুলোতে যতদূর চোখ যায় সবুজের হাতছানি। ঘেরের আইলে ও ঘেরের আইলের উপরে নির্মিত সারি সারি মাচায় ঝুলছে করলা, লাউ, কুমড়া, বরবটি, চিচিংগা, ধুন্দল আর শসা। আইলে উপরে রয়েছে ঢেঁড়শ, পুঁইশাক ও কলাগাছ। বর্ষাকালীন সবজির পাশাপাশি আগাম শীতকালীন সবজি চাষও শুরু করেছেন অনেকে।
সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়ক সংলগ্ন তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের মিঠাবাড়ি বিলে শতশত বিঘা জমির মাছের ঘেরে মাচা পদ্ধতিতে লাউ, কুমড়া ও করলার চাষাবাদ করা হয়েছে। মাচায় ঝুলছে হাজার হাজার করলা, শতশত লাউ ও কুমড়া। একই সাথে ঘেরের পাড়ে লাগানো হয়েছে পুঁইশাক, ঢেঁড়স ও কলা গাছ।
নগরঘাটা ইউনিয়নের গাবতলা গ্রামের ইসরাইল হোসেন জানান, তিনি ১৬ একর জমিতে মৎস্য ঘের করেছেন। তার তিন
পাশে সবজি চাষ করেছেন। তার ১৬ একর জমির তিন পাশের সবজি চাষে সবমিলে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মত খরচ হয়েছে। যেখান থেকে সবজি পাওয়ার সময় চলে এসেছে কম-বেশি। তিনি আরো বলেন, যদিও সবজি চাষ আমার মূল লক্ষ ছিল না তবে ঘেরের বেঁড়িতে সবজি চাষ করাটা অধিক লাভজনক। একারণে প্রতিবছরই আমি ঘেরের বেঁড়িতে সবজি চাষ করে থাকি। আবহাওয়া অনূকুলে থাকলে ও বাজারদর ভালো পেলে আশাকরি আমি দেড় থেকে দুই লাখ টাকার সবজি বিক্রি করতে পারবো।
একই এলাকার অপর ঘের ব্যবসায়ী মোহর আলী জানান, তার প্রায় ১ একর জমিতে মাছের ঘেরের পাশাপাশি সবজি চাষ করেছেন। ঘেরের বেড়ির চারপাশ দিয়ে ডাবল সিস্টেমে সবজির বেড়া দিয়ে সবজির মাচা দিয়েছেন। ঘেরের বেড়ির উপর লাগানো সবজি থেকে ৫০হজার টাকার বেশি মুনাফা অর্জন করা যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
জেলার বিভিন্ন জায়গার সবজি চাষিরা জানান, বর্তমানে দেশে ও বিদেশে সবজির ব্যাপক চাহিদা হওয়ায় গতকয়েক বছরে জেলার মাছের ঘেরের আইলে সবজি চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে মাছের ঘেরে মাচা পদ্ধতিতে সবুজ সবজির চাষ কৃষিতে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছেন দাবি করে তারা বলেন, মাচা পদ্ধতিতে সবজি চাষে বদলে গেছে তাদের মতো জেলার বহু কৃষকের ভাগ্য।
সাতক্ষীরা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক নুরুল হুদা জানান, বর্তমানে জেলার অধিকাংশ ঘেরের পাড়ে সবজি চাষ হচ্ছে। ঘের পাড়ে উৎপাদিত লাউ, উচ্ছে, শসা ও বরবটি আরো আগে থেকে জেলার বাজার গুলোতে আসতে শুরু করেছে। কৃষকেরাও ভালো দাম পাচ্ছেন। জেলার মানুষের আয়ের একটা বিশাল অংশই এই ঘেরের পাড়ের সবজি চাষ থেকে আসে। এ কারণে আমরা কৃষকদের পাশে মাঠ পর্যায়ে সব সময় আছি। প্রান্তিক কৃষকদের সবজি বাগান পরিদর্শন করে তাদের সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহতও রাখবেন বলে জানান তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ন কবির বলেন, বিগত কয়েক বছরে মাছের ঘেরের আইলে সবজি চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে সাতক্ষীরায়। আর পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় অতিতের তুলনায় ভবির্ষতে আরও কৃষি বিপ্লব ঘটবে এ অঞ্চলে। তাঁর মতে, সাতক্ষীরা সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ির রাজধানী হিসেবে পরিচিত থাকলেও সবজি উৎপাদনে এ জেলার আলাদা একটি সুনাম রয়েছে। বছরের বিভিন্ন সময় এ জেলা থেকে উৎপাদিত সবজির প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদিত হয় মাছের ঘেরের আইল
থেকে। যেটা জেলার চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ সবজি রাজধানীসহ পদ্মার ওপারের বিভিন্ন জেলায় যায়।
তিনি বলেন, একটা সময় ছিল যখন ফেরিঘাটে সময় বেশি লাগায় অনেক সবজি নষ্ট হত, এতে কৃষকরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতেন। তবে পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় বর্তমানে সবজি নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি ভালো দামও পাবে এঅঞ্চলের কৃষকেরা।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, মৎস্য ঘেরের আইলে সবজি চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে যেন কোন সিন্ডিকেট কাজ করতে না পারে সেজন্য কঠোর অবস্থানে থাকবে জেলা প্রশাসন। জেলার প্রান্তিক পর্যায়ের চাষীরা যেন তাদের উৎপাদিত সবজির ন্যায্য মূল্য পায় সেজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিত্যদিন বাজার মনিটরিং করা হবে। কোথাও কোন সিন্ডিকেট কাজ করলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদেরকে শাস্তির আওতাই আনা হবে বলে জানান তিনি।
এমআই