মো. তুহিন হোসাইন
ও আমার মনি রে....
ও আমার জাদু গো.....
সদর হসপিটালের সিঁড়ির নিচ থেকে থেমে থেমে কান্নার রোল প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আজ সারাদিন ধরেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হয়েছে। একটু আগেও হালকা বৃষ্টি হয়ে গেলো। এখন ঠাণ্ডা মৃদু বাতাস বইছে। প্রকাণ্ড সেগুন গাছ থেকে ঝুর ঝুর করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। হসপিটালের মেইন গেটে বাধানো ইলেকট্রিক ঘড়িতে লাল আলোয় জ্বলে আছে সময় রাত এক টা পাঁচ। হসপিটালের সামনে ওষুধের ডিসপেনসারি, প্রায় সব গুলোই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু মাত্র দুটি দোকান এখনো খোলা আছে। দোকানের মালিক গায়ে চাদর লেপ্টে চেয়ারে বসে ঘুমচ্ছে। বেশ জোরেই নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথে দুইজন কর্মচারি বসে বসে ঝিমাচ্ছে। মেইন রোড দিয়ে কিছু সময় পর পর হুস হুস করে দূর পাল্লার গাড়ি গুলো ছুটে যাচ্ছে। গাড়ির শব্দ নিঃশেষ হওয়ার সাথে সাথেই আবারো সেই কান্নার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তবে এবার আগের থেকে আরও জোরে।
নিধু ডোম এদিক সেদিক ব্যস্ত ভাবে ঘোরাঘুরি করছে। পা জড়িয়ে আসছে, হয়তো কিছু ক্ষণের মধ্যে টলে পড়বে। আজ ঠাণ্ডা দেখে একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। তার কাছে এই এক ঘেয়েমি কান্না বিরক্ত লাগছে।
মানুষ হয়ে জন্মাইলে একদিন মরবার লাগবো এতো কান্দনের কি আছে?
বেকুব মেয়েছেলে!
তেত্রিশ বছর ধরে এ পেশায় আছি। কেউ মরলি পারে এই মেয়েছেলেই জ্বালায় বেশি।
উুঁ ও আল্লা রে, হুঁ ঘাড় ছিড়ে গেলো রে।
রীনা কনে গেলি তুই?
তোরে বললাম ঘাড় টিপতে চুল টানছিস ক্যান হারামজাদি।
সাদেক বেশ কিছু সময় ধরে হসপিটালের ইমারজেন্সি রুমে বসে কাতরাচ্ছে। তার বউ রীনা উদ্বিগ্ন চোখে এদিক ওদিক দেখছে। সে কান্নার শব্দে কিছুটা সময় অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। তাই মনের ভুলে কখন ঘাড় টিপতে গিয়ে চুল টানা শুরু করেছে বুঝে উঠতে পারেনি। মাস খানেক আগে এই ঘরের মধ্যেই তার আব্বা হাঁপাতে হাঁপাতে মারা যায়।
"আব তো হোস না খাবার হে
ইয়েহ কেসা আসার হে
তুমসে মিলনে কি বাদ দিলবার
ডিজে সলিম"
খুব মৃদু আওয়াজে আক্কাস গানের ভিডিও দেখছে,সেই সাথে তালে তালে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। মাঝে মাঝে আঁড়চোখে আবার রীনাকে দেখছে। আক্কাসের একটা লক্কর মার্কা এম্বুলেন্স আছে তার বেশির ভাগই রাতে ডিউটি থাকে। যখন কোন কাজ থাকে না ইমারজেন্সি রুমে এসে নার্সদের সাথে আড্ডা দেয়। বেশ কড়া জর্দা দিয়ে সে আরাম করে পান খাচ্ছে। রুমের মধ্যে তিনটা ডাস্টবিন সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা "এখানে ময়লা ও প্যাড রাখুন"। আক্কাস পিচ শব্দ করে পানের পিক ফেললো । সেটা ডাস্টবিনে না পড়ে তার গায়ে লাগলো। বিরক্তিতে তার মুখ কুচকে গেলো। লাল পিকে শার্ট মাখামাখি, চোখ বড়বড় করে লালা শার্টের দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে আক্কাস।
চ্যাংড়া একটা ছেলে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে ঘুরছে। সে সাদেকের সামনে এসে দাঁড়ালো।
দেখি আপনার হাতটা প্রেশার মাপতে হবে.?
সাদেকের চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে। রীনা তার হাতটি ধরে এগিয়ে দিলো।খুব গম্ভীর ভাবেই প্রেশার মাপছে চ্যাংড়া ছেলেটি। ছেলেটি প্রেশার মেপে কিছু না বলেই আবার ঘোরাঘুরি শুরু করলো। সাদেকের গোংরানি আরও জোরালো হয়ে আসছে।
হন্তদন্ত ভাবে এম. বি. বি. এস করিমুল্লাহ এসে গম্ভীর গলায় বললো, রুগী কে?
চ্যাংড়া ছেলেটি দৌড়ে এসে সাদেক কে দেখালো
এই তো স্যার।
করিমুল্লাহ বিরক্তি মাখা গলায় বললো শুয়ে পড়ুন।
প্রেসার কত.?
স্যার ১৫০ বাই ৯০
হার্টের সমস্যা কাল সকালে আমার চেম্বার চলে আসবেন ইসিজি করা লাগবে।
এই বলে করিমুল্লাহ দ্রুত সরে পড়লো।
পাশের রুম থেকে ঘুমন্ত একটি নার্স এসে হড়বড় করে বললো,
রোগীর নাম, বয়স, ঠিকানা বলুন টিকিট কাটা লাগবে।
রীনা একদৃষ্টিতে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো নার্সটির দিকে।
রাত ৩ টা ২১ ল্যাম্পপোষ্টের লাইট গুলো মিটমিট করে জ্বলছে। শহরের এক চিপা গলি থেকে টর্চ হাতে দফাদার টহল দিচ্ছে। পাতলা একটি চাদরে তার শরীর আবৃত। নিখুঁত ভাবে খুঁটেখুঁটে প্রতিটি দোকানের তালা পরীক্ষা করছে। মাঝে মাঝে গলির শেষ পর্যন্ত লাইট দিয়ে দেখছে। টহল শেষে আবুল মিয়ার চায়ের দোকানে বসলো।
দীর্ঘ ক্লান্তিতে একটু হাফ ছেড়ে বললো,
এই যে মিয়া কড়া ঝাল দিয়ে ডিম রুটি ভাজো সাথে ডাবল হিটের এক কাপ দুধ চা।
মো. তুহিন হোসাইন
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
সময় জার্নাল/এলআর