ডাঃ নুসরাত সুলতানা:
জ্বর কোন রোগ নয়, বরং রোগের উপসর্গ। একটা সময়ে জ্বর আসলে বলা হতো জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল খেতে, শরীর স্পঞ্জ করতে এবং বেশী বেশী তরল জাতীয় খাবার খেতে; পাচ-সাতদিনে জ্বর না কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে। ধরে নেয়া হতো ভাইরাসজনিত জ্বরে তেমন কিছু হয়না। সাতদিনে ভালো হয়ে যায়।
২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতি এই ধারনা বা ভাবনা পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন জ্বরকে কোনভাবেই অবহেলা করা যাবেনা, কোনভাবেই না।
ডেঙ্গু তো আগেও ছিল, তবে এখন কেন এত সতর্কতা?
ডেঙ্গু ভাইরাস ৪ ধরনের। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এর ৪ টি সেরোটাইপ (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩, ডেন-৪)এবং প্রত্যেকটি সেরোটাইপই বাংলাদেশে আছে। ডেঙ্গু জ্বর দুই ধরনের ক্লাসিক্যাল বা সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর ও রক্তক্ষরনজনিত ডেঙ্গু জ্বর। কেউ যদি প্রথমবারের মত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তিনি সাধারনত ক্লাসিক্যাল বা সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে ভুগবেন। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তক্ষরনজনিত ডেঙ্গু জ্বর হয়। তবে এখানেও আছে একটি জটিল সমীকরণ। প্রথমবার ডেন-১ দিয়ে আক্রান্ত হলে আপনার শরীরে ডেন-১ এর বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হবে। ফলে পরবর্তীতে ডেন-১ এ এক্সপোজড হলে আপনার ডেংগু হবেনা। কিন্তু বিপত্তি ঘটবে তখনই যদি প্রথমবার ডেন-১ এবং দ্বিতীয়বার ডেন-১ ছাড়া অন্য কোন সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হন। ধরুন আপনি দ্বিতীয়বার ডেন-২ দিয়ে আক্রান্ত হলেন, তখন কি হবে? আপনার শরীরে ডেন-২ প্রবেশ করার ৪৮ ঘন্টা পর হতে ডেন-১ এর বিরুদ্ধে তৈরীকৃত এন্টিবডি রক্তে আসবে যা ডেন-২ সেরোটাইপের সাথে ঠিকই বন্ধনে যুক্ত হবে কিন্তু নিষ্ক্রিয় করতে পারবেনা বরং রক্তের শ্বেতকণিকার মধ্যে ঢুকে বংশবিস্তার করবে এবং আরো অনেক শ্বেতকণিকা জড়ো করে বিভিন্ন ধরনের সাইটোকাইন নিঃসৃত করে রক্তক্ষরণ ঘটাবে। একে বলে Original antigenic sin। এই Original antigen হচ্ছে ডেন-১, যেটা দিয়ে আপনি প্রথমবার (কয়েক মাস বা কয়েকবছর আগে) আক্রান্ত হয়েছিলেন।
২০১৮ সালের আগে ডেঙ্গু পরিস্থিতি তো এত খারাপ ছিলনা, এখন কেন?
২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেন-৩ সেরোটাইপের প্রাধান্য বেশী ছিল। ২০০৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত যা ডেন-১ বা ডেন-২ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। ২০১৮ সালে ডেন-৩ আবার ফিরে আসে প্রবলভাবে এবং প্রতিস্থাপন করে অন্যগুলোকে। এতে করে একটা বড় সংখ্যার মানুষ বিশেষ করে যারা ২০০৩ থেকে ২০১৭ এর মধ্যে জন্মগ্রহন করেছে, তারা ডেন-৩ দ্বারা প্রথমবারের মত আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ ডেন-৩ আক্রমন করার জন্য একটি নতুন প্রজন্মকে পায়।ফলে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকের ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু হয় এবং যারা আগে অন্য সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল, তাদের রক্তক্ষরনজনিত ডেংগু হয় ও অনেকেই প্রান হারায় । অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ও মারা গেছেন ও যাচ্ছেন।
অনেক কারণে জ্বর হতে পারে। টেস্ট না করলে আপনি কখনো জানবেননা আপনার ডেঙ্গু আছে কিনা বা কখনো হয়েছিল কি না। তাই জ্বর আসার ৭২ ঘন্টার মধ্যে যে টেস্ট দুটি অবশ্য অবশ্যই করাবেন তা হচ্ছে, NS1 for Dengue এবং CBC। ভুলেও এ কথা বলবেননা আপনার কখনো ডেংগু হয়নি। বেশিরভাগ সময় আমরা জ্বরকে অবহেলা করি, কবে কোন এক সময় আপনি ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন আপনি নিজেও জানেননা। মনে রাখবেন, দ্বিতীয়বার আপনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে মৃতুমুখে পতিত হতে পারেন।
আমাদের করণীয়ঃ
• নিজের বাড়ি, বাড়ির আশপাশ নিজে উদ্যোগ নিয়ে পরিস্কার করুন, ঝোপ-ঝাড় কেটে ফেলুন।
• বাড়ির অব্যবহৃত টয়লেট একদিন পর পর ফ্ল্যাশ করুন।
• পানিতে গাছ রাখলে, সেই পানি একদিন পরপর পরিবর্তন করুন।
• শিশুদের শরীরের উন্মুক্ত অংশে মস্কুইটো রিপেলেলেন্ট লাগান।
• রাস্তায় চলার পথে ডাবের খোসা, টায়ার, পাত্র পড়ে থাকতে দেখলে তা তুলে ফেলে দিন। আপনার এই কাজে অন্যের জীবন বাচবে এবং একই ঘটনা ঘটবে আপনার ক্ষেত্রেও।
• প্রতিদিন এরোসল দিয়ে ঘরের প্রতিটি কোণা স্প্রে করুন। স্প্রে করার সময় ঘরের পর্দাগুলো ঝেরে নিন।
• গরমের দোহাই দিয়ে মশারী না টানিয়ে ঘুমাবেননা। পারলে দিনের বেলা ঘুমালেও মশারী টানান।
আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক
ভাইরোলজী বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ।