চৈত্র মাসের খড়তপ্ত দিনেই নাকি মেয়েদের নাক-কান ফুটো করার উপযুক্ত সময়।চড়া দিনে চামড়ার টান পরে। মালতির দাদিমা মালতির নাক-কান ফুটো করে দিয়েছে। মাস শেষের আরো সাত দিন বাকি।পহেলা বৈশাখে সে সোনার ফুল-দুল পরবে। মালতির খেলার সাথি সুলতানা। সেদিন দাদিমা সুলতানাকেও নাক ফুটো করে দিয়েছে। মালতির নাক-কানের সুতা পরিষ্কার থাকলেও সুলতানার নাক একদম কাঁচা। সুতা মোটা, ঘুরাতে কষ্ট হয়। মালতি নিয়মিত ওষুধ খেতে পারলেও সুলতানা পারেনি।তবে ওর ভাই সুজন বলেছিল, মেলায় তাকে দোকান থেকে নাকফুল কিনে দিবে। এনিয়ে সুলতানার উত্তেজনার শেষ নাই।
সুজন কাঁচা আমের পাতায় সরিষার তেল গরম করে টগবগে তেল হাত দিয়ে আস্তে আস্তে লাগিয়ে দেয় বোনের নাকে। সুতা ঘোরানোর চেষ্টা করে। সৎ মা ভাত রান্ধার সময়, গরম ভাতের ফ্যান লাগিয়ে দেয় সুজন। বৈশাখের আর বেশি দেরী নাই যে।
সুজন সুলতানার থেকে ৪ বছরের বড়। সুলতানার ২বছর বয়সে মারা যায় ওর মা। আর ৫ বছর ধরে মায়ের দায়িত্ব পালন করছে সুজন। বাবার দ্বিতীয় পক্ষের একটা ছেলে আছে। ওরা তিনজন ছাড়া উটকো ঝামেলা সুজন আর সুলতানা।
রাত পোহালেই চৈত্র সংক্রান্তি। দুই ভাই-বোনের মাঝে উত্তেজনা আর ভোরের অপেক্ষা। নানান রীতি-নীতি দিনটিকে ঘিরে। শাক তুলতে হবে কাল তাদের,নতুন আম মুখে দিতে হবে। কিন্তু পাবে কোথায়?
একসময় রাত ফুরিয়ে যায়। ফজরের আযান দেয়, চারিদিকে মুসল্লীরা নামাজে যাচ্ছে। সুলতানা ভাইকে ডেকে দেয়। বছরের শেষ দিনের নামাজে যাওয়ার জন্য। মায়েরা বলে রমজান মাসের প্রথম রোজা আর শেষ রোজা করলেই সব রোজার সাওয়াব পাওয়া যায়। সুলতানা নামাজের ক্ষেত্রেও তাই মনে করে।
সামছুল চাচার শাকের আবাদ। অনেকেই তার শাক কিনে নিবে আজ। কিন্তু সুলতানা ওর সৎমাকে বলেছিল শাক না কিনতে। বাবা সারাদিন রিকশা চালিয়ে যে উপর্জন করে তা দিয়ে তাদের হয় না। তার উপর সৎ ভাইয়ের জন্য প্রতিদিন মকবুল চাচার গাইয়ের দুধ কিনতে হয়। অতএব, সুজন আর সুলতানা শাক কুঁড়াতে বের হবে। ধানক্ষেতের পাশে হেলেঞ্চা শাক হয়, তবে চুরিও করা যায় শাক ক্ষেত থেকে। অনেকেই তো করে কিছু তো হয়না।
সারাটা দুপুর দুই ভাইবোন এর খেত ওর খেত থেকে শাক তুলে আনে। সামছুল চাচা সুজনকে দেখেও দেখিনি ভাগ্যিস। তখন সুলতানা খুব ভয় পেয়েছি। ওদের ক্ষেতে লাল শাকটা খুব হয়েছে। সাতশাকি, অর্থাৎ সাত রকমের শাক খেতে হবে। মালতীর দাদিমা বলেছে, সাতশাকি খেলে নাকি বাথ ব্যাথা হয়না। আরো বলেছিল নতুন বছরের আম খেতে। কিন্তু শাক আরো বাকি একটা। লাল শাক,পাটশাক,হেলেঞ্চা শাক,কলমি শাক,লাউশাক,বাতুয়া শাক তোলা হইছে। আর একটা শাকের কয়েকটা পাতাও মিলতেছে না।
এদিকে দুপুর বেলার পরে আম খাওয়ার কথা ছিল। সুজন সুলতানাকে নিয়ে, বাড়ির পিছনদিয়ে দৌড় দেয় মালতীদের বাগানে। ওদের বাগানে বড় বড় আমের গাছ।আর মিষ্টি আম সব।
আম তলায় মালতি আর ওর দাদিমা আম পাড়ছে, কোঁটা দিয়ে। তবুও নাগালে আসছে না। সুজন যাওয়াতে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। সুজন উঠে পর গাছে। দাদিমার এমন আশ্বাসে সুজন গাছে উঠতে লাগল। বড় বড় আমগুলো সে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল। মালতি আর সুলতানা উচ্ছাসে আমগুলো কুড়িয়ে জামার কোছ ভর্তি করল।
দারুন উচ্ছাসে মালতিদের বাড়ির ভিতর আসল সবাই। কাকিমা চাউল ভাজছেন। সাথে নিমপাতা। এটাও নাকি একটা নিয়ম, রোগ বালাই দূর হয়। কাকি একথালা চাউল ভাজা লবন মরিচ দিয়ে মেখে নিয়ে আসলো। সুলতানা কাঁচা মরিচ, লবন দিয়ে ডলে আম চুবিয়ে খেল কিন্তু চাউল ভাজা খেতে চাচ্ছে না। সুজন আম না খেলেও চাউল, নিমপাতা ভাজা খাচ্ছিলো। দাদিমা বার বার জোর করার পর, নিরবতা ভেঙ্গে সুলতানা বলল,আব্বার চাউল ভাঁজা খুব পছন্দ। শুনেই মুচকি হাসলেন কাকিমা।
মালতি তার নববর্ষের ডালা-কুলা দেখালো, সাথে লাল রঙের একটা জামা। ওর বৈশাখী জামা। দাদী একটা প্যাকেট এনে সুলতানাকে দিল। সুলতানার একটাই জামা।নোংরা আবার ঘাড়ের কাছে ছিড়ে যাওয়া। কাল ওটা পরেই মেলায় যাবে ভেবেছিল। নতুন জামা পেয়ে আহ্লাদে আটখানা সুলতানা। কাকিমা জামাটা গায়ে দিয়ে দিলেন। মাপ ঠিক হয়েছে কিনা পরখ করলেন।
ততক্ষণে দাদী আরো একটা প্যাকেট গুছিয়ে নিলেন। তাতে নতুন আম,নিম পাতা আর দুই মগ চাউল দিলেন। আবার আগামীকালের নিমন্ত্রণও তারা পেল।
নতুন জামা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা সুলতানা। সুজনের চোখের কোনায় জল। সব বোনের মতই ওর বোনও কাল নতুন জামা পরে মেলায় যেতে পারবে। ভাবতেই ভালো লাগছে ওর। বাগান পার হয়ে খোলা জমিতে দৌঁড়াতে লাগল সে। পিছনে সুজন। বড় জমি পার হতেই মুখ থুবড়ে পরে যায়,সুলতানা। সুজন দৌড়ে আসে বোনের কাছে। বোনের চোখ মুছিয়ে দিল। কিন্তু যেখানে পরে ব্যাথা পেল তারপাশেই নজর গেল সুজনের, সেখানে জঙ্গল। আর তাতে কুমড়ো শাকের পাতা লকলক করছে। আর কোন ভাবনা নেই।
ওরা শাক নিয়ে বাড়িতে ফিরল। সুজনের বাবা,তার ছোট সৎ ভাইয়ের জন্য ছোট একটা পাঞ্জাবি এনেছে। সেটার মাপ নিচ্ছে মা। খুব রাজপুত্রের মত লাগতেছিল ওকে।
সুজন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।
আছরের পর, সুজন বাড়িতে নাই। বাড়ির পাশে ছেলেদের সাথে রঙ খেলার আয়োজন করছে। সুলতানা বাবার জন্য চাউল ভাজছে। নতুন লাল জামাটা এখনো গায়ে।কিন্তু সমস্যা হল, সুলতানা চুলায় আগুন দিতে পারে না। বাতিতে আগুন লাগিয়ে পাশেই রাখল, যাতে নিভে গেলে আবার নিতে পারে। যখন সে কড়াইয়ে চাউল নাড়ছে,পটপট শব্দ হচ্ছে। চাউল ফুটে উড়ছে, আবার নিচের অংশ গরম লাগছে। গরমের মাত্রাটা বেড়েই চলছে।
হঠাৎ নিচে চোখ পরাতে আগুন দেখল, নতুন জামাটাকে গিলে খাচ্ছে।
ঠিক এই মূহুর্তে কি উচিত সুলতানা জানে না। শুধু দুইবার আগুন বলে চিৎকার করেছিল। সুজন বাড়ির পিছন থেকে দৌড়ে এসে দুইবার ভাবেনি। হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল আগুন। নতুন জামার জলন্ত আগুন নিমিষেই নিভে গেল সুজনের হাতে। কাতর বোনকে বসিয়ে পোড়া হাত ধুয়ে নিল সে। ততক্ষণে বাবা-মা ঘর থেকে বের হয়েছে। বাবার কটুক্তি, কে তোকে আমার জন্য চাউল ভাজতে বলেছিল।
সুজনের তখন একটা কথাই মনে হচ্ছে,বড়রা ঠিকই বলে,মা সৎমা হলে বাবাও সৎবাবা হয়।
১৪২৯ বঙ্গাব্দ, সকাল থেকেই আমেজ চারিদিকে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা নতুন জামায় সজ্জিত। সুলতানা কাল জামাটা পুটিয়ে ফেলছে, নয়ত আজ সুজনের মন খারাপ হত না। আলু ভর্তা পান্তা দিয়ে শুরু হল সুলতানা আর সুজনের নতুন একটি বছর। বাড়ির সামনে দিয়ে অনেক বড় র্যালি চলছে। র্যালির পিছনে দেখা যাচ্ছে সুজনকে, সুলতানাকে সে ডেকেই যাচ্ছে। দৌঁড়ে যোগ দেয় সুলতানা। গায়ে কালকের সেই রিপু করা জমা।
মেলার মাঠে প্রচন্ড ভীর। পা ফেলার জায়গা নাই। নানান আয়োজন। এক চুড়ি-ফিতার দোকানে এসে দুই ভাইবোন ভীর জমালো। সুজনের পাঁচ টাকার বিনিমনে সুলতানা বেছে নিল একটা নাকফুল।
লেখল : শিক্ষার্থী, কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ কুড়িগ্রাম।