নিজস্ব প্রতিবেদক:
গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, লিডো এবং যুক্তরাজ্যের কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন এবং কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে “পথশিশুদের বঞ্চনা ও অধিকার” বিষয়ক সেমিনার আয়োজিত হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (১৫ই সেপ্টেম্বার) দুপুর ২টায় ঢাকার সিরডাপ মিলমায়তনে গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, লিডো এবং যুক্তরাজ্যের কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন এবং কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে “পথশিশুদের বঞ্চনা ও অধিকার” বিষয়ক সেমিনার আয়োজন করা হয়।
প্রধান অতিথি হিসেবে সেমিনারে ইন্টারনেট-জুম-এর মাধ্যমে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোঃ আশরাফ আলী খান খসরু এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকেন অধ্যাপক মেঘনা গুহঠাকুরতা। সেমিনারের শুরুতে কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন-এর জনাব স্টিফেন কলিন্স উপস্থিত সকল ব্যক্তিবর্গদের স্বাগত জানান এবং সেমিনারের পটভূমি বর্ণনা করেন। সেমিনারে পথশিশুদের উপর পরিচালিত সামাজিক জরিপের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে তৈরি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি (এটঈ)-এর নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ।
কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন এবং কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশনের যৌথ সহায়তায় এবং গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি পরিচালিত গবেষণা তথ্যে দেখা যায় যে, যদিও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ (UNCRC), জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, শিশু শ্রম নির্মূল নীতি ২০১০ এবং শিশু আইন ২০১৩ ইত্যাদির প্রতি বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ, কিন্তু পথশিশুরা নিয়মিত তাদের অধিকার লঙ্ঘনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে। এই গবেষণা দেখায় যে, কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া বাংলাদেশের পথশিশুরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং বাংলাদেশ সরকারের ৮ বছর দীর্ঘ পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫) বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে পিছিয়ে পড়ে থাকবে।
গবেষণার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩১%) শিশুরা একা থাকে এবং ১২% বলে যে তারা বন্ধুদের সাথে বা রাস্তায় অন্যদের সাথে থাকে। ১১% শিশুরা অনাথ, যাদের কোন অভিভাবকই বেঁচে নেই এবং ৩৫% জানে যে তাদের মা অথবা বাবা মারা গিয়েছে। প্রায় অর্ধেক (৪৪%) শিশু রাতে ঘুমানোর জন্য বস্তির বাড়িতে ফেরত যায়, যেখানে অন্যরা খোলা জায়গাগুলোতে যেমন-পরিবহন টার্মিনালে, রেল স্টেশন, লঞ্চ ঘাট, যানবাহনে, পার্কে এবং রাস্তার পাশে ফুটপাতে ঘুমাতে যায় ।
বেশিরভাগ পথশিশুরা পেটের তাগিদে কাজ করে এবং/অথবা টাকার জন্য ভিক্ষা করে, গড়ে দিনে ১০ ঘন্টা। ৩৫% ভিক্ষা করার কথা বলে, অন্যদিকে ৪২% রাস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি করে। সিংহভাগ পথশিশুরাই (৯৮.৫%) প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে না। অন্য সকল শিশুর ন্যায়, পথশিশুদের সকল বৈষম্য, অবহেলা এবং নিপীড়নসহ সকল প্রকার সহিংসতা থেকে মুক্তির অধিকার রয়েছে। তবুও ঢাকা ও বরিশালের পথশিশুদের জন্য সহিংসতা ও নির্যাতন খুব সাধারণ ঘটনা। তিন-চতুর্থাংশেরও অধিক (৭৯%) শিশুরা জীবনের কোনো এক পর্যায়ে মানসিক (৭৬%), শারীরিক (৬২%) এবং/অথবা যৌন (রিপোর্ট অনুযায়ী ৫%- কিন্তু বাস্তবে আরো বেশি হতে পারে) সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে। এ সকল নির্যাতনের শিকার অর্ধেকের বেশি শিশু বলেছে যে অপরাধীর সাথে তারা রাস্তায় বা পার্কে বা কোনো খোলা জায়গায় নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে। অন্যরা বলেছে- ট্রেনে অথবা জল পরিবহনে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
পথশিশুদের মাঝে স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা খুবই সাধারণ। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৩% এরই কোনো না কোনো ধরণের প্রতিবন্ধিতা দেখা গিয়েছে। শতকরা ষাটভাগ শিশু (৬০%) গত তিনমাসে জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা বলে, সাথে অন্যান্য সাধারণ লক্ষণসমূহ যেমন- কাশি (৩৫%), সর্দি (২৬%), মাথাব্যাথা (২৫%) এবং পেটে ব্যথা (২২%) এসব রোগে ভোগার কথা তারা বলেছে। ৮৫% শিশু যারা চিকিৎসা বিষয়ক উপদেশ বা চিকিৎসা পেয়েছে, তারা এগুলো পাশকরা ডাক্তারের বদলে স্থানীয় ওষুধের দোকানের ঔষধ বিক্রেতা বা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র পেয়েছে। পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে, ৬২% পথশিশুরা গণশৌচাগার ব্যবহার করে (৭% অন্যান্য যায়গার শৌচাগারে প্রবেশ করতে পারে) এবং বাকিরা ড্রেন বা খোলা জায়গা ব্যবহার করে।
যে কোনো জরুরি অবস্থায়, পথশিশুরা আরো বেশি অসহায় হয়ে পরে। কোভিড-১৯ মহামারি যখন বাংলাদেশে পৌছায়, জীবিকার জন্য যে সকল শিশুরা পথের উপর নির্ভর করতো তারা বিশেষ করে লকডাউনের অর্থনৈতিক প্রভাবের দ্বারা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ২০২০ এর প্রাথমিক লকডাউনে, ৭২% পথশিশু খাদ্যাভাবে ভোগে, আবার ৬৫% এর কাজ ছিলো যেটার উপর তারা নির্ভর করতো তা হারিয়েছিল এবং ৫৩% পথশিশু তাদের থাকার যায়গা বা যেখানে তারা সাধারণত ঘুমাতো সেগুলো হারায়। পথশিশুরা করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে ধারণা করে সব জায়গার দারোয়ানরা তাদের লঞ্চঘাট, পথঘাট, ফুটপাথ, রেলষ্টেশন থেকে তাড়িয়ে দেয়। তাদের জীবনের দুরাবস্থার কারণে অনেক শিশুরাই কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতা উপদেশ মেনে চলতে পারেনি।
গবেষণাতে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের পথশিশুদের শিক্ষা ও খাদ্য পাবার এবং সহিংসতা থেকে রক্ষা পাবার অধিকার নিয়মিত লঙ্ঘিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা যে এসকল শিশুরা তাদের প্রতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী পিছিয়ে পড়ে না থাকে।
বাংলাদেশ সরকারের সকল পথশিশুদের অধিকার দেওয়ার এখন সক্ষমতা রয়েছে এবং মাননীয় প্রধানমনন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন যে ‘‘একটি শিশুও আর পথে থাকবেনা”। তাই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা এবং জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের জন্য সকল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আমারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে, কার্যকর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে এবং তাদের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ যোগানদানের জন্য আহŸান জানাচ্ছি। আমরা আরোও বিশেষভাবে আবেদন জানাচ্ছি যে মেয়ে পথশিশুদের সুরক্ষার বিষয়টা যেন অতি জরুরিভাবে সবাই বিবেচনা করে এই সংকটের সমাধানে সবাই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করি।
সেমিনারে ঢাকা আহসানিয়া মিশন (DAM)-এর জনাব মোহাম্মদ জুলফিকার মতিন পথশিশুদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকারের আন্ত-বিভাগীয় সমন্বিত উদ্যোগের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। লিডো (LEEDO)-এর জনাব আরিফুল ইসলাম ও গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির কর্মসূচি পরিচালক জনাব খন্দকার রিয়াজ হোসেন পথশিশুদের টাস্কফোর্স সম্বন্ধে এবং গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির কর্মসূচি ব্যবস্থাপক জনাব সাবরিনা আলমগীর পথশিশুদের সাথে সম্পর্ক তৈরির বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
পথশিশুদের মানবিক উন্নয়ন এবং অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বরিশাল সমাজসেবা কার্যালয়ে উপ-পরিচালক জনাব মো: এ কে এম আখতারুজ্জামানকে সম্মামনা প্রদান করা হয়।
এশিয়া মহাদেশের আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তান থেকে কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন-এর বিভিন্ন দেশের নেটওয়ার্ক সদস্য প্রতিষ্ঠান অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম জুম এর মাধ্যমে সেমিনারে যোগদান করেন।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে প্রতিমন্ত্রী মোঃ আশরাফ আলী খান খসরু ও বিশেষ অতিথি মেঘনা গুহঠাকুরতা বক্তৃতা প্রদান করেন। সভায় সম্মানীত অতিথির বক্তব্য রাখেন শ্রম উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মিসেস কামরুন্নেসা আশরাফ (দিনা)। ঢাকা আহসানিয়া মিশনের যুগ্ম পরিচালক (এডুকেশন এন্ড টিভেট) মোঃ মনিরুজ্জামান সমাপনী বক্তৃতা প্রদান করেন। পরবর্তীতে লিডোর নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেইন সভার সভাপতির বক্তৃতা দেন। সর্বশেষে কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়া ম্যাকরে তার বক্তৃতা প্রদান করে অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
এমআই