বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

কবি শামসুর রাহমান: দীপ্তিময় কবিতার উজ্জ্বল সারস

রোববার, অক্টোবর ২৩, ২০২২
কবি শামসুর রাহমান: দীপ্তিময় কবিতার উজ্জ্বল সারস

মাইন সরকার:

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ শামসুর রাহমান -- ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকায় নানাবাড়ি মাহুতটুলীতে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর পৈত্রিক বাড়ি তৎকালীন ঢাকা জেলার বর্তমান রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে। শামসুর রাহমান ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই, এ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। তবে তিনি ১৯৫৩ সালে বি. এ পাস কোর্সে পাস করে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় দ্বিতীয়  বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি।

শামসুর রাহমান যাপিত জীবন কালের বড় অংশই কেটেছে প্রগতির পথে আধুনিক কবিতা সৃষ্টিতে, পুরনো ঢাকায় বেড়ে ওঠা কবির নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁর নাগরিক কবিতায়। বলা হয়ে থাকে জীবনানন্দের পর দুই বাংলা মিলিয়ে শামসুর রাহমানই `সবচেয়ে বড় কবি`। ত্রিশের দশকের বিশিষ্ঠ পাঁচ জন কবি রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে গিয়ে বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন। তাদের পাঁচ জনকে বাংলা সাহিত্যে পঞ্চ পান্ডব বা কল্লোলের কবি বলা হয়। তারা হলেন-- অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে  ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তারপর পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলা ভাষায় শামসুর রাহমানই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ। আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমান। জীবিত কালেই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন, 'মিজানুর রহমান তৈমাসিক  পত্রিকা 'র সম্পাদক মিজানুর রহমান বাংলাদেশের সর্বশেষ্ঠ সাহিত্য সম্পাদক এবং বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক, প্রাবন্ধিক ভাষাবিদ ও সুপণ্ডিত হুমায়ূন আজাদ শামসুর রাহমানকে নিয়ে লিখে গেছেন " শামসুর রাহমান নিঃসঙ্গ শেরপা। কবি, অনুবাদক ও সাংবাদিক জুয়েল মাজহারের ভাষ্যমতে "শামসুর রাহমান চকিত ঝলকসর্বস্ব কবি নন। ছোট দৌড়ের উসাইন বোল্ট নন। বরং তিনি এক ম্যারাথন রেসার। ইথিওপিয়ার ম্যারাথন রেসার আবিবি বিকিলার মতো। যিনি জুতাহীন খালি পায়ে অলিম্পিকে ম্যারাথন রেস জিতে দুনিয়াকে চিনিয়েছিলেন নিজের জাত। শামসুর রাহমানও বাংলাদেশের কবিতায় খালি পায়ে দৌড় শুরু করা এক আবিবি বিকিলা।"

১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। এছাড়াও ষাটের দশকে প্রকাশিত কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ ও আমি অনাহারী। কবি নাগরিক হলেও এই বাংলার চির সবুজ গ্রাম পাড়াতলীতে কেটেছে কবির শৈশব, কবির নদীর নাম মেঘনা যা বাংলাদেশের গভীরতম প্রশস্ত খরস্রোতা নদী, মেঘনা নদীকে নিয়ে কবি লিখেন--

'মেঘনা নদী দেব পাড়ি কল- অলা এক নায়ে
আবার আমি যাব আমার পাড়াতলী গাঁয়ে।'

কবির বহুল পঠিত কবিতা ' তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা ' মেঘনা পাড়ে বসেই রচনা করেছিলেন। শামসুর রাহমান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক আলোকিত মানুষ।  ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী  রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান - এ
কর্মরত ছিলেন। পেশাগত তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসংঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন এবং সব রকমের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উনি ধিক্কার জানিয়ে ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা
আন্দোলন নিয়ে তিনি লেখেছিলেন--

আগুন তাতা সাঁড়াশি দিয়ে তোমরা উপড়ে ফেলো আমার দুটি চোখ
সে দুটি চোখ, যাদের প্রাপ্ত দীপ্তির মৃত্যুহীন, বিদ্রোহী জ্বালায়
দেখেছি নির্মম আকাশের নিচে মানবিক মৃত্যুর তুহিন- স্তব্ধতা,
দেখেছি বাস্তুহারা কুৃমারীর চোখের বাষ্পকণার মতো কুয়াশা- ঢাকা দিন,
দেখেছি মোহাম্মদ, যীশু আর বুদ্ধের বিদীর্ণ  হৃদয়,
তাদের রক্ত ঝরে ঝরে পড়ছে সাদা সাদা অসংখ্য
দাঁতের কুটিল হিংস্রতায়।
( একুশে ফেব্রুয়ারি)

বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযোদ্ধ নিয়ে তিনি রচনা করেছেন অজস্র অনবদ্য কবিতা। তাঁর রচিত বন্দিশিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ কাব্যগ্রন্থগুলোয়  প্রবলভাব  উঠে এসেছে গণ মানুষের স্বর।

শামসুর রাহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন 'হাতির শুঁড়' নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা 'টেলেমেকাস'।

ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের মহানায়ক শহীদ আসাদ, ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি রচনা করেন " আসাদের  শার্ট " কবিতাটি --

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্ত করবীর মতো কিংবা সূর্যোস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের ,
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।

এরকম দীপ্তিময় বহুকবিতার এক উজ্জ্বল সারস কবি শামসুর রাহমান। একদিকে তাঁর রাষ্ট্র চিন্তা অন্যদিকে রাষ্ট্রে শেকড় যে সমাজ, সেই সমাজকে নিয়েও তিনি ভেবেছেন। লিখেছেন। হুমায়ূন আজাদের এক সাক্ষাৎকারে তার কিছুটা আংটা খুঁজে পাওয়া যায়। হুমায়ূন আজাদ শামসুর রাহমানকে প্রশ্ন করেছিলেন- আপনি কোন ধরনের সমাজ ব্যবস্থায় সুখবোধ করতেন?
শামসুর রাহমান তখন বলেছিলেন--

"আমি তেমন একটি সমাজে স্বস্তি বোধ করবো
যেখানে মানুষকে অনাহারে থাকতে হয় না, মানুষের
পরার কাপড় থাকবে, খাবারের নিশ্চয়তা থাকবে,
এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব   ক্ষুণ্ন হবে না-- এরকম সমাজে
আমি থাকতে পছন্দ করবো যে- সমাজ শোষণহীন
নিপীড়নে মানুষ মারা যাবে না এবং তাঁর ব্যক্তিসত্তাটা  ক্ষুণ্ন  হবে না।"

সারাটা জীবন কবি অন্ধকারের বিরুদ্ধে তাঁর কলমকে সজাগ রেখেছেন জাগ্রত থেকেছে চিন্তা ও চেতনায়। ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ  করে লেখেন কবিতা ' বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়'।

নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।

শামসুর রাহমান যেমন একজন কবি হিসেবে খ্যাতিমান আবার শিশুকিশোর সাহিত্যিক হিসেবেও শামসুর রাহমান এদেশের প্রথম সারির একজন এবং শিশুকিশোরদের প্রতি ছিলো  অকৃত্রিম মায়া ও ভালোবাসা তাঁর শিশুকিশোর সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য -- এলাটিং বেলাটিং,  ধান ভানলে কুঁরো দেব, গোলাপ ফোটে খুকীর হাতে, স্মৃতির শহর, রংধনুর সাঁকো, লাল ফুলকির ছড়া, নয়নার জন্য, আমের কুঁড়ি জামের কুঁড়ি,  নয়নার জন্য গোলাপ প্রভৃতি। এছাড়া বেশ কিছু গানও রচনা করেন কবি যেমন আমাদের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার কণ্ঠে তাঁর একটি গান

স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে
পানি টলমল মেঘনা নদীর কাছে
অমার অনেক ঋণ আছে,
আমার অনেক ঋণ আছে
যখন হাওয়ায় উড়ে কালো হলদে পাখি
আমি কেবল মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি....।

বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য শামসুর রাহমান আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি  পুরস্কার (১৯৮১), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণ পদক (১৯৮১) ভাসানী পুরস্কার (১৯৮২), পদাবলী পুরস্কার (১৯৮৪) স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯২) সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকা তাঁকে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত করে। ওই বছর তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৬ সালে সাম্মানিক ডিলিট উপাধী দান করে কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী।

এমআাই 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল