মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি:
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারি মানুষের নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, নদীভাঙন, নদীতে পানির জোয়ার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হচ্ছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার মানুষদের। আর এসব দুর্যোগে শিশু ও নারীরা বিভিন্ন রোগে আক্রন্ত হচ্ছেন।
প্রত্যন্ত এ অঞ্চলের নারীদের মাসিকের সময় ব্যবহার করতে হয় লবনাক্ত পানি, পাশাপাশি যে কাপড় ব্যবহার করেন সেখানকার নারীরা সেটিও পরিষ্কার করতে হয় লবণাক্ত পানিতে। এসবের ভয়ে উপকূলীয় নারীরা পিরিয়ড বন্ধ করতে নিচ্ছেন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল। ফলে তারা চর্ম ও জরায়ুজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার সেই রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অকালে জরায়ু খুইয়ে সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারাচ্ছেন।
এখানেই শেষ হচ্ছে না তাদের দুর্বিষহ জীবনগাথা, এরপর শুরু হচ্ছে নানামুখী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ানক যন্ত্রণা, যা বাকি জীবন একাই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই নারীদের। স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকের আশঙ্কা, এভাবে দিনের পর দিন পিল খেলে নিয়মিত মাসিক বন্ধ, বন্ধ্যাত্বসহ জরায়ুর ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হতে পারে নারীরা।
উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের সুব্রত মন্ডলের স্ত্রী শেফালী মন্ডল। দিনমজুরের কাজ করেন শেফালী। দীর্ঘদিন থেকেই ভুগছেন জরায়ুর সমস্যায়। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের নারীদের সবচেয়ে বেশি জরায়ুর সমস্যা। আমরা লবণাক্ত পানিতে গোসল করি, কিন্তু পানিটা নিরাপদ নয়। তাই এই রোগ বাড়ছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মতো উপকূলীয় এলাকাগুলোতে নোনা পানির আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা। সারাটা বছর তাদেরকে নোনা পানির সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে হচ্ছে, বিশেষ করে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে।
দুই সন্তানের মা রহিমা বেগম বলেন, ‘আগে তো মাসের কিছুদিন শুধু পেটে ব্যথা করতো। অপারেশনের পর এখন সারাক্ষণ গা দিয়ে দাহ ওঠে। কাটা জায়গায় জ্বালা-যন্ত্রণা করে। মনে হয়, পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি, তাহলে একটু আরাম পাব। জরায়ু অপারেশনের পর থেকেই প্রচন্ড রকম মাথা ও শরীর জ্বালায় ভুগছেন বলে জানান ৩০ বছর বয়সী আসমা বেগম।
সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সুশীলন। সংহস্থাটির প্রকল্প প্রকৌশলী শামীম হাসান বলেন, বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব এবং গোসলসহ দৈনন্দিন কাজে অপরিচ্ছন্ন ও মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানি ব্যবহারের কারণে তারা শুধু জরায়ু ও চর্মরোগেই ভুগছেন না, শিশু-কিশোরী-নারীরা লিউকোরিয়া, রক্তশূন্যতা, আমাশয়সহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগেও ভুগছেন। লবণাক্ত পানি ব্যবহারে খোলপেটুয়া গ্রামেই প্রায় দেড়শ’ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। যাদের অনেকেই ছোট থেকেই লম্বা হয় না। মাথা ও পেট মোটা হয়ে যায়। ফলে শুরু থেকেই তারা নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে বড় হচ্ছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের সাতক্ষীরা ইউনিটের সমন্বয়ক এস এম শাহীন আলম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন উপকূলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূল এলাকার নারীদের মধ্যে গর্ভধারণের সংখ্যা কমে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে গর্ভপাতের পরিমাণও। অনেকের চুল পড়ে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে এসব অঞ্চলে।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. ফাতেমা ইদ্রিস ইভা বলেন, মেয়েরা তাদের ঋতু¯্রাব বন্ধের জন্য পিল খাচ্ছেন। এ কারণে মাসিকের সমস্যাসহ নানাধরনের রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ খেলে হরমোনের যে কাজ করার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন রীতা রানী পাল বলেন, অল্প বয়সে জরায়ু কেটে ফেললে নারীদের হট ফ্লাস (হাত-পা ও শরীর জ্বালাপোড়া), অল্পতে মেজাজ উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতেই থাকে। তিনি জানান, বছর খানিক আগে ২ হাজার ৬০০ নারীর ‘জরায়ুমুখ’ পরীক্ষা করানো হয়। তাদের মধ্যে ৫৮ জনের জরায়ুমুখে ক্যান্সারের পূর্বলক্ষণ দেখা দেয় এবং দু’জনের জরায়ুমুখে ক্যান্সার ধরা পড়ে। তবে লবণাক্ত ও দূষিত পানি ব্যবহার পানিবাহিত রোগের অন্যতম কারণ সেটা প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ে বাস্তবসম্মত গবেষণা প্রয়োজন।
সময় জার্নাল/এলআর