মইনুল কাদের :
"বেশ চলছি দুলকি চালে, শহর এলাকা ছাড়িয়ে এসেছি এখন দুই পাশে গ্রাম, ধানের খেত, পুকুর, রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে রিকশা, গরুর গাড়ি যাচ্ছে দুটা একটা। চারিদিকে তেমন ব্যস্ততা নাই, আমাদেরও তেমন তাড়া নাই।"
এই যে অসাধারণ রূপকল্প - প্রকৃতির আর সময়ের,
কিংবা
"আহ, সবাই খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম, রান্নাও অসাধারণ,রূপচাঁদা মাছ ভাজা, ইলিশ মাছ, মাছের ডিম, মুরগির মাংস আর ঘন ডাল সঙ্গে ধোঁয়া উঠা সাদা ভাত যেন শিউলি ফুল!"
আর শিউলি ফুলের মতো ভাতের এই মোহনিয় চিত্ররূপ একেঁছেন আনোয়ার ভাই উনার "জার্নি ফ্রম গ্রামীণফোন টু আমাজন" বইতে।
মাত্র ১৪২ পৃষ্ঠার বইটি অসংখ্য ছোট ছোট ঘটনার ঠাসবুননে গাঁথা সময়ের এক গতিময় চিত্র। স্বচ্ছ - ঝরঝরে- ঝর্নার জল পড়ার মতো ছন্দময় গতিশীল ভাষায় লেখা - পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখা এক উপাখ্যান।
আনোয়ার ভাই ১৬ বছর গ্রামীণফোনে ছিলেন। ১৯৯৭ থেকে ২০১৩। আড়ং হাউসের ছোট্ট পরিসরে ঘড়ি কোম্পানি মনে করে চাকরির সাক্ষাতকার দিতে যাওয়া, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হওয়া, কোম্পানিটির আঁতুড়ঘর থেকে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানোর সেই যাত্রাপথে আনোয়ার ভাইও একজন ছিলেন - উপন্যাসে পড়া সেই নাবালিকা মায়ের মতো- যে নিজে এবং তার সন্তান একই সাথে বড় হচ্ছিল।
আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লেখার সবচেয়ে বড় বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা বা সীমাবদ্ধতা যাই বলা হোক না কেনো- সেটা হচ্ছে- "আমিত্ব"। লেখককে বাধ্য হয়েই পুরো লেখায় "আমি" "আমি" করে যেতে হয়। এই "আমিই" নায়ক।
গ্রীক পুরানের বীর কিংবা পুরো রাজ্য যখন গভীর সংকটে; রাজা- উজির- নাজির- কোতোয়াল যখন সমস্যার কোন সুরাহা করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে বিমর্ষ - তখন সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া হাড় জিরজিরে এক পথিক।
সমস্যার সমাধান হলো- সারা রাজ্য জুড়ে চল্লিশ দিন উৎসব চললো। কোন উপকথার নায়ক বা এই হাড় জিরজিরে পথিকটিই হলো- আত্মজীবনী/ স্মৃতিকথার -"আমি"। আত্মজীবনীর এই "আমিত্বের" সমস্যা শ্বাশত - দুর্লঙ্ঘনীয়।
আনোয়ার ভাইয়ে কৃতিত্ব হচ্ছে - তিনি তাঁর "আমিত্বের" রাশ টেনে ধরতে পেরেছেন। যেহেতু স্মৃতিকথা তাই স্বাভাবিকভাবেই বারবার "আমি" এসেছে- কিন্তু সেই আমি কখনোই রুচির সহনীয় সীমা অতিক্রম করেনি- যা বইটিকে অনন্য পাঠ উপভোগ্য করে তুলেছে।
আনোয়ার ভাই গ্রামীণফোনের যাত্রাপথের বিবরণ দিয়েছেন। ছোট্ট একটি দল কিভাবে ধীরে ধীরে বড় হলো আর জয় করলো তার বিবরণ।
গ্রামীণফোনে যেদিন আনোয়ার ভাই যোগ দিয়েছিলেন সেদিন এক ভদ্রলোক এসেছিলেন আনোয়ার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। এসে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন- "আমি ইঙ্গে স্কার"। ইঙ্গে স্কার তখন গ্রামীণফোনের এমডি।
গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ারে/ইনফো সেন্টারে কাজ করতেন আনোয়ার ভাই। সেই সূত্রে দেশের সব রথি মহারথিদের সাথে উনার পরিচয় আর সখ্যতা হয়েছিল।
ক্রিকেটার ফারুক আহমেদ তখন প্রধান নির্বাচক। "ফারুক ভাই বললেন,- "আমার বিয়ে, ভাবিকে নিয়ে আসতেই হবে আনোয়ার ভাই!"
কিংবা সেনাকুঞ্জে " মিসেস লায়লা হারুন হেসে পরিচয় করিয়ে দিলেন- "ইনি আমার হাজবেন্ড, জেনারেল হারুন, বর্তমান আর্মি চিফ! আর হারুন, এই হচ্ছে আনোয়ার"।
জেনারেল হারুন, সেনাবাহিনী প্রধান আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,- "আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আনোয়ার!..
আপনি.. আমার সমস্যা সমাধান করে দিয়েছিলেন! আই ওয়াজ রিয়েলি ইম্প্রেসড ইয়াং ম্যান এন্ড স্টিল আই এম। উই বোথ আর গ্রেটফুল টু ইউ"!
উনার এই পরিচয়ের গন্ডি সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে বিস্তৃত হয়েছিল- ড: আকবর আলী খান থেকে শুরু করে পিচ্চি শামীম পর্যন্ত....
এই বই নিয়ে লিখতে গেলে হয়তো এই লেখার দৈর্ঘ্য মূল বইয়ের সমান হয়ে যেতে পারে। তাই বরং বিচ্ছিন্ন কয়েকটা ঘটনা ছু্ঁয়ে যাওয়া যাক- এই ঘটনাগুলো কর্পোরেটের চিরায়ত চিত্র।
"পরেরদিন খবরটা এল! আমি নই, "আমোদ স্বর্ণকার" প্রোমোশন পেয়েছে! কর্পোরেট পলিটিক্স এর প্রথম স্বাদ পেলাম।"
সেনাকুঞ্জের সেই অনুষ্ঠানে ঢোকার মুখেই আনোয়ার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল গ্রামীণফোনের তখনকার প্রধান মার্কেটিং কর্মকর্তার। যিনি আনোয়ার ভাইকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আরে আনোয়ার তুমি? কিভাবে? " -- তাচ্ছিল্য ছিল উনার স্বরে।
আনোয়ার ভাই বেশ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন গ্রামীণফোনের ফ্রানচাইজি পার্টনারদের বিদ্রোহ আর ডেলভিস্তা অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে।
আনোয়ার ভাই লিখেছেন- "জিপি ম্যানেজমেন্টের সেই আচরণ আমি কোনদিন ভুলব না! কাপুরুষের মতো সবাই স্রেফ পালিয়ে গেছে"। এখানে আনোয়ার ভাই ঘটনার পূর্নাঙ্গ বর্ণনা দিয়েছেন এবং কোন কোন কর্তাব্যক্তিরা পালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের নামও লিখেছেন। পালিয়ে যাওয়া একজন কর্তাব্যক্তির পরবর্তী ব্রান্ডিং হয়েছিল "কর্পোরেট বালক"।
আনোয়ার ভাই বলেছেন, গ্রামীণফোন অকালমৃত্যুর হাত থেকে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প, কিভাবে গতানুগতিক নেতৃত্ব বাতিল হয়ে যায় নতুন উদ্ভাবনী নেতৃত্বের কাছে, কিভাবে কর্পোরেটসূত্রে পরিচয়কে ব্যক্তিগত সম্পর্কে রূপান্তরিত করে সেই সম্পর্ক দিয়ে আবার কর্পোরেট সমস্যা সমাধান করেছিলেন। এছাড়া আরো অসংখ্য গ্রামীণফোন কেন্দ্রিক কর্পোরেট আর ব্যক্তিগত কাহিনী।
এইসব গল্পের আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে - গ্রামীণফোনের অনেকেই গল্পগুলোর মাঝে নিজেদের অনেক ঘটনার ছায়া খুঁজে পাবেন আর আনোয়ার ভাইয়ের বলা চরিত্রগুলোও সবার পরিচিত যা গ্রামীণফোন সংশ্লিষ্টদের জন্য আলাদা আবেদন সৃষ্টিকারী।
এবার একটু সমালোচনা করা যাক!
অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো গ্রামীণফোনেও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর "তৈলের" প্রভাব গভীর ও বিস্তৃত। এখানে অনেক বিড়াল তেলের জোরে বাঘের সিংহাসন দখল করে রাজত্ব করে। এই রোজায় দোকানে দোকানে যে ডুবো তেলে জিলাপি ভাজা হয় তেমনি এখানেও অনেক কর্তাব্যক্তিরা তেলের মধ্যে জিলাপির মতো পূর্নাঙ্গ শরীর ডুবিয়ে বসে থাকেন। তৈলবাজদের দৌড়াত্মে অনেক প্রতিভার অকাল মৃত্যু হয় এখানে প্রতিদিন। আনোয়ার ভাই এই তৈল বিষয়ে কোন কিছু লিখেননি- যা এই বইটির একটি ছোট্ট অপূর্ণতা।
শেষ করা যাক--
আনোয়ার ভাইয়ের প্রথমদিনের একটি ঘটনা দিয়ে।
"এক কোনায় এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। উনার কাছে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি ইকবাল কাদির! আমাকে দেখেই ইকবাল কাদির হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন। খুবই সাদামাটা একজন মানুষ, উনার আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ানোটা আমাকে বেশ আলোড়িত করল, জানলাম উনি কোম্পানির একজন ইনভেস্টিং ডিরেক্টর।"
সদ্য জীবনের প্রথম চাকরিতে যোগ দেয়া একজন নবীন কর্মীকে সন্মান জানিয়ে প্রতিষ্ঠাতার উঠে দাঁড়ানোর মাঝেই হয়তো গ্রামীণফোনের পরবর্তী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা প্রাপ্তির ভিত্তি লুকানো ছিল!
বইটির ব্যাপ্তি আরো বড় হলে ভালো হতো! এই বই রোলার-কোষ্টারের সেই রোমাঞ্চকর যাত্রার মতো- যার যাত্রা হঠাৎ শেষ হয়ে যায়- যাত্রীর আক্ষেপ থেকে যায় আরেকটু চড়ার!
আশা করি আরো ঘটনা যুক্ত করে আনোয়ার ভাই এই শীর্ণকায় বইটিকে আরেকটু পুরুষ্টু বানানোর উদ্যোগ নিবেন!
লেখক : মইনুল কাদের
প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জিপি এমপ্লয়ি এসোসিয়েশন।
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।