শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

মেঠোপথে শুভর ‘আলোকিত পাঠাগার’

শনিবার, এপ্রিল ২৪, ২০২১
মেঠোপথে শুভর ‘আলোকিত পাঠাগার’

২৩ এপ্রিল বিশ্বগ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস বা বই দিবস। এ দিনকে বিশ্ব কপিরাইট দিবসও বলা হয়। ইউনেস্কো ঘোষিত দিবসটি বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে গুরুত্বের সাথে পালন করা হচ্ছে। বই ও পাঠাগার প্রেমিদের কাছে দিবসটির গুরুত্বই আলাদা।

করোনার মহামারীর কারনে এ বছর দিবসটি স্ব-শরীরে উদযাপন করা হচ্ছে না। প্রতি বছরই দিবসটি ঘিরে আমরা মুখোমুখি আলোকিত মুখের। বাংলাদেশে পাঠাগার গড়ার মাধ্যমে বইপড়া আন্দোলনকে যারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে অন্যতম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের ফরাশগঞ্জ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আরিফ চৌধুরী শুভ। মেঠোপথে আলোকিত পাঠাগার নামে একটি পাঠাগার দিয়ে ২০১৫ সালে শুরুটা হলেও বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশে পাঠাগার গড়ার কাজ করে যাচ্ছেন একঝাঁক তারুণ্যকে নিয়ে। 

জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন নামে সংগঠন সৃষ্টি করে তারই মতো শতাধিক উদ্যোগী তারুণ্যকে খুঁজে বের করে গড়েছেন শতাধিক নতুন পাঠাগার। এছাড়াও প্রায় ৩ শতাধিক পাঠাগারকে বিভিন্নভাবে সেবা দিয়েছেন। কাজের স্বীকৃতি স্মরুপ আলোকিত পাঠাগার ও জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন সংগঠনটি পেয়েছে সরকারি স্বীকৃতি। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিভিন্ন মহলে প্রশংসা কুড়ানো এই তরুণ বর্তমানে পড়াশুনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ডিপার্টমেন্টের মাস্টার্সে। এছাড়া প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আলোকিত পাঠাগার এবং জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন (জাপাআ)।  

নদীভাঙ্গা ও সুবিধাবঞ্চিত ঝরেপড়া শিশুদের বিদ্যালয়মুখি করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন আলোকিত স্কুল। গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের বইপড়ার কথা চিন্তা করে ২০১৫ সালে গড়ে তোলেন আলোকিত পাঠাগার। দৃশ্যমান একাধিক সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে মেঠোপথের আরিফ ও তার আলোকিত পাঠাগার। প্রশংসা কুড়িয়েছে সর্বমহলের। ২০১৫ সালে বেসরকারি উচ্চ শিক্ষায় ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনটিতেও এই তরুণের ছিল বড় ভূমিকা। নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে এগিয়ে যাওয়া এই তরুণের চোখে মুখে আজ জাতীয় মুক্তির আকাঙ্খা। বই-পাঠক-পাঠাগার নিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সময় জার্নালের প্রতিবেদক মো. নিজাম উদ্দিন

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : কখন থেকে পাঠাগার করার ইচ্ছা?

শুভ : আমার ইচ্ছাটা ছিল দু:খবোধ ও আপসোস থেকে। ছোটবেলায় সাইকেল চালিয়ে ১৬ মাইল দূরে জেলা শহরে গিয়ে সরকারি গণগ্রন্থাগার থেকে বই এনে পড়ার কষ্টকর অভিজ্ঞতা থেকে গ্রামে পাঠাগার করার প্রথম ইচ্ছেটা হয়। ছেলেরা সাইকেল চালিয়ে জেলা শহরের গ্রন্থাগার থেকে বই এনে পড়তে পারলেও মেয়েরা সেটি থেকে বঞ্চিত। আমি সবাইকে বই পড়ার সুযোগ করে দিতে চাই। সমবয়সী তরুণদের নিয়ে বার বার পরিকল্পনা করেও একটি পাঠাগার গড়ে তুলতে পারিনি গ্রামে। পরে বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময় টিউশানি করে টাকা জমিয়ে একাই উদ্যোগ নিলাম। তাছাড়া আপনি চিন্তা করে দেখেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাহিরে সমাজে প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু সার্বজনীন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে সবাই একত্রিত হয়ে জ্ঞান চর্চা করতে পারে। একটা সমাজে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, রাজনৈতিক ক্লাব, স্কুল কলেজ ও নানানমুখি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু একটি পাঠাগারই নেই। পাঠাগার হলো জনগণের বিশ^বিদ্যালয়। আজ সেই কাজটিই আমরা সারাদেশে করে যাচ্ছি।

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : কি কি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে?

শুভ : শুরু করার আগে ভেবেছি বইয়ের কোন শত্রু নেই, কিন্তু কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রতিটি মুহুর্তে। একটা দুষ্ট চক্র যেকোন কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার জন্য কৌশলটাও জানা থাকতে হবে। গ্রাম্য রাজনীতিটা একটা প্রকট সমস্যা। অর্থের সমস্যার সমাধান করা সহজ, কিন্তু রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে পারলে আর কোন সমস্যা থাকে না। মানসিক সাপোর্ট ও দরকার আছে। গ্রামে আমি যখন পাঠাগার উদ্বোধন করি, তখনতো এলাকার কেউ আসেননি। শুধুমাত্র আগত অতিথিরা আমি আর আমার স্কুলের বাচ্চারা মিলেই পাঠাগারটি উদ্বোধন করেছি। সেই পাঠাগারের সফলতা থেকেই এখন পর্যন্ত শতাধিক পাঠাগার করেছি।

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : অর্থ নেই, কিন্তু পাঠাগার করার ইচ্ছে আছে?

শুভ : সফলতার জন্য এই ইচ্ছাটাই দরকার সবার আগে। অর্থের চেয়ে উদ্যোগী মানুষটাই বেশি দরকার। সৎ উদ্যোগ অর্থের জন্যে থেমে থাকে না। অর্থ একটা সাময়িক সমস্যা মাত্র। বড় করে শুরু করার অপেক্ষা না করে ছোট পরিসরে হলেও যেটা করতে চাই, সেটা শুরু করে দেয়াটাই হলো উত্তম। মাত্র ১০টা বই দিয়ে পাঠাগার শুরু করেছে অনেকে। এখন তাদের পাঠাগারে হাজার হাজার বই। ২০১৫ সালে আলোকিত পাঠাগার শুরু করেছি নিজের পড়া মাত্র ২৯০টি বই দিয়ে। এখন প্রায় ৩ হাজারের বেশি বই রয়েছে। 

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : পাঠাগারের জন্য কি কি অবকাঠামো থাকতে হবে?

শুভ: পাঠাগারের জন্য আলাদা একটা কক্ষ থাকলে ভালো। যাদের সেই ব্যবস্থা নেই, তারা বসতঘরের কোন একটা জায়গায় ছোট্ট একটি সেল্প দিয়ে শুরু করে। পাঠকরা প্রথম প্রথম নিজের পরিচিতজন থাকেন, পরবর্তীতে পাঠক ও পাঠাগারের গন্ডি বড় হয়। একটা রুম, একটি টেবিল একটি বইয়ের সেল্প হলেই পাঠাগার শুরু করা যায়। তবে প্রত্যাহ পাঠাগার খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : আমি পাঠক হতে হলে কি করতে হবে?

শুভ : পাঠকদের একটা কমন জিজ্ঞাসা থাকে। বই কি বাড়িতে নিয়ে পড়তে পারি? পাঠক আর পাঠাগার দুটোই একটা কয়েন মনে হয় আমার কাছে। প্রতিটি পাঠাগারের আলাদা নিয়ম থাকতে পারে। পাঠাগারের নিয়ম যদি হয় বই বাড়িতে নিয়ে পড়া যাবে, তাহলে পাঠক সেই নিয়ম অনুসরণ করবে। নিয়মিত পাঠকরা সদস্য হওয়ার মাধ্যমে পাঠাগারের সাথে সম্পৃক্ত হয়। অস্থায়ী বা ভ্রাম্যমাণ পাঠকদের ক্ষেত্রে সদস্য হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এক সময় এই পাঠক ই পাঠাগারের দায়িত্ব নেয়।

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : বই পড়ার জন্য কি কোন টাকা দিতে হয় পাঠককে?

শুভ: পাঠাগারের সদস্য ফি যদি ধার্য থাকে, তাহলে সেটি দিয়ে সদস্য হতে হবে আগে। তবে এই ফি সামান্য। ১০ টাকা বা ২০ টাকা হতে পারে মাসে। এই চাঁদা যেমন পাঠাগারের প্রতি পাঠকের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে, তেমনি পাঠাগার পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। তবে আলোকিত পাঠাগারে পাঠকদের জন্য কোন চাঁদা নেই। এর ব্যয়ভার আমি একাই বহন করি এখনো। 

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : আলোকিত পাঠাগারে উল্লেখযোগ্য কি কি বই পাওয়া যাবে?

শুভ : প্রতিটি বই ই পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তবে কিছু বই যেগুলো পাঠাগারে না রাখলে নয়, এমন বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। বন্দি মুজিব, একটি অখ- মানচিত্র, লং ওয়ার্ক টু ফ্রিডম, বাঙালী ও বাংলা ভাষা, রোড নম্বর ৩২, জাতির পিতা, রক্তে কেনা স্বাধীনতা, পায়ের আওয়াজ শুনতে পাই, জোৎস্না ও জননীর গল্প, সফলদের সফল কথা, নেলসন মেন্ডেলা, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি, নূর হোসেন এক জলন্ত পোস্টার, একাত্তর ভেতরে বাইরে, উঠোন পেরিয়ে দুপা, নারীর মূল্য, তোমরা সুন্দর হও, স্বচ্ছ কাঁচ, দেয়াল, নিষিদ্ধ মুদ্রার ফসিল, জল জবা জয়তুন, শহীদ মিনার, উইকিলিকস এ বাংলাদেশ, ক্রাইম রিপোর্টিং, একাত্তরের চিঠি, শেষ বেলা, জহির রায়হান, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র, বেগম রোকায়া, সুফিয়া কামাল, শিশুতোষ বই, সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীদের বইসহ পাঠাগারে আরো অনেক বই রয়েছে। শতাধিক ম্যাগাজিন, ছোটদের বই ও সাহিত্য পত্রিকা আছে।

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : আলোকিত পাঠাগারের পাঠক কারা?

শুভ : পাঠকের কোন বয়স নেই। কেউ আসে পত্রিকা পড়তে, কেউ আসে শুনতে, আবার কেউ বইয়ের পাঠক। পুরো ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই পাঠক। পাঠাগারে বই পড়া ও নিয়ে যেতে পারে তারা।

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : আলোকিত পাঠাগারের আলো কতদূর যাবে? 

শুভ : অন্ধকারে আলোই পথ চলার একমাত্র অবলম্বন। জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বির্নিমাণে পাঠাগারের বিকল্প নেই। চোখের আলো না থাকলে আলোকিত পৃথিবী অন্ধকার। পাঠাগার হলো এ সামাজের আলো। সমাজের অন্ধকার দূর করতে হলে প্রতিটি সমাজে পাঠাগার গড়ে তোলা উচিত। আমি আমার সমাজে উদ্যোগী হয়ে পাঠাগার গড়েছি। প্রত্যেকের উচিত তাদের সমাজে পাঠাগার গড়ার উদ্যোগ নেয়া। বই পড়ি পাঠাগার গড়ি আমরা। জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন তাদের সহযোগীতা করবে যারা পাঠাগার গড়তে আগ্রহী।

সময় জার্নাল/আরইউ


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল