বুধবার, জানুয়ারী ৪, ২০২৩
মুহা: জিল্লুর রহমান, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি:
সকলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সাতক্ষীরার সাংবাদিকতার প্রতীক পুরুষ অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহিম। বুধবার (৪ জানুয়ারি) বেলা ১১টায় সাতক্ষীরার শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পর্কে জানাযা নামাজ শেষে শহরের কামালনগর সরকারি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজা নামাজে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা অংশ গ্রহণ করেন।
এর আগে বুধবার বেলা ১০টায় অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহিম এর মরদেহ আনা হয় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে। সেখানে জেলার কর্মরত সাংবাদিকরা সহ সর্বস্তরের জনগণ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। এসময় প্রেসক্লাব চত্বরে শোর্কত মানুষের ঢল নামে। সাংবাদিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে শ্রদ্ধা জাননো হয়। সকাল ৯টায় অধ্যাপক আনিসুর রহিমের মরদেহ নেয়া হয় শিক্ষক হিসেবে তাঁর চাকুরীকালীন সর্বশেষ কর্মস্থল সাতক্ষীরা দিবা-নৈশ কলেজ ক্যাম্পাসে। পরে মরদেহ আনা হয় শহরের মুনজিতপুরে অবস্থিত তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাতক্ষীরা প্রি-ক্যাডেট স্কুলে।
বীরমুক্তিযোদ্ধা (সার্টিফিকেট গ্রহণকারী নন) মরহুম অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহিম ছিলেন জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক, অধুনালুপ্ত দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র পত্রিকার সম্পাদক, সাতক্ষীরা প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, সুলতানপুর আজাদী সংঘ ক্লাবের সদস্য, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক, দৈনিক পত্রদূতের সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি।
মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি) সকালে তিনি সপরিবারে সুন্দরবন ভ্রমনে যান। লে র উপরে পরিবারের সদস্যদের সাথে আলাপচারিতায় ছিলেন। একপর্যায়ে আমলকি ফল খাওয়ার সময় দুপুর ১টার দিকে হটাৎ অসুস্থ্য বোধ করে টলে পড়েন। এসময় তার ছোটভাই অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসি ডাঃ আশিকুর রহিম তাকে ধরে বসানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
আপোষহীন সাহসী সাংবাদিকতা করার কারণে অসংখ্যবার অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহিম হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে তিনি অন্যায় অসত্যের কাছে মাথানত করেননি। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার রহস্য তিনিই সর্বপ্রথম উন্মোচন করেন। সেই সূত্র ধরে সারাদেশে একে একে ধরা পড়ে জঙ্গিরা।
অধ্যাপক আনিসুর রহিম ১৯৫৫ সালের ৭ মার্চ নড়াইল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আরিফুর রহিম সেসময় নড়াইল সিও রেভিনিউ বিভাগে ম্যানেজার পদে চাকরি করতেন। নড়াইল থেকে তার পিতা বদলি হয়ে আসেন সাতক্ষীরায়।
অধ্যাপক আনিসুর রহিম সাতক্ষীরা সিলভার জুবলি প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা থেকে বদলি হয়ে বরগুনায় যার আরিফুর রহিম। ১৯৭১ সালে বরগুনা থেকে মেট্রিক পাশ করেন। মেট্রিকুলেশন পাশ করে যশোর এমএম কলেজে ভর্তি হন। যশোর এমএম কলেজ থেকে ১৯৭৩ সালে এইচএসসি পাশ করেন। অধ্যয়নকালীন তিনি যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে। সেসময় যশোরে তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন শক্তিশালী সংগঠনে রূপ নেয়। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করে সহপাঠী দিলারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
অধ্যাপক আনিসুর রহিমরা ৬ ভাই ও ৩ বোন। তাঁর দুই ছেলে এবং এক স্ত্রী। পারিবারিকভাবে ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বরগুনায় থাকার সময় অধ্যাপক আনিসুর রহিম যোগদেন মুক্তিযুদ্ধে। সরাসরি যুদ্ধ করেন। সহযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলে শক্তিশালী ব্রিগেড। তবে মুক্তিযুদ্ধের সনদের জন্য তিনি কখনো চেষ্টা করেননি। ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। ‘সাপ্তাহিক একতা’ পত্রিকায় তাঁর হাতেখড়ি। এরপর কলম ধরেছেন একাধিক পত্রিকায়, লিখেছেন অনর্গল। দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর অসংখ্য লেখা প্রকাশ হয়েছে। প্রত্যেকটি লেখায় তিনি অধিকার ও ন্যায়ের কথা বলেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি সস্ত্রীক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন সাতক্ষীরা মহিলা কলেজে। সাতক্ষীরা মহিলা কলেজ জাতীয়করণ হলে তিনি চাকরি ছাড়েন। এরপর তিনি দেবহাটার খান বাহাদুর আহসানউল্লা কলেজে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে ফিরে আসেন সাতক্ষীরা ডে-নাইট কলেজে। এ কলেজে তিনি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে সুনামের সাথে চাকরি জীবন সম্পন্ন করেন তিনি। এদিকে কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি শিশু শিক্ষা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গড়ে তোলেন আসমানী শিশূ নিকেতন ও পরে সাতক্ষীরা প্রি-ক্যাডেট স্কুল। তার হাত ধরেই জেলায় কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম সূচনা করে। এরপর জেলাজুড়ে কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিপ্লব দেখা যায়, যা অধ্যাপক আানিসুর রহিমের চিন্তার ফসল।
১৯৯৬ সালে তিনি সাতক্ষীরার গণমানুষের কণ্ঠস্বরকে একসূত্রে গেঁথে প্রকাশ করেন দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র পত্রিকা। দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র প্রকাশ হলে জেলায় সাংবাদিকতায় আসে নতুন গতি। আসে এ পেশার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস। আনিসুর রহিমের সম্পাদনায় দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র পত্রিকায় সাহসী সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে এক ধরণের সামাজিক আন্দোলন। দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্রে সাহসী প্রতিবেদন ছাপার কারণে কয়েকবার হামলার শিকার হন আনিসুর রহিম। দুর্বৃত্তরা তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে। হুমকি দিয়েছে। কিন্তু হামলা ও হুমকি তাকে সত্যের কক্ষপথ থেকে এক বিন্দু সরাতে পারেনি। দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বীরমুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রদূতের সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৮ সালে ভূমিহীন আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাঁকাল ইসলামপুরে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে যে আন্দোলন শুরু হয় সেই আন্দোলনে তার সাহসী ভূমিকা আজও অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগায়। ১৯৮৮ সালের ৪ অক্টোবর এই ভূমিহীন আন্দোলনের কারণেই তিনি গ্রেপ্তার হন। তাকে সাতক্ষীরা থেকে যশোর কারাগারে রাখা হয়। ৬ মাসের অধিক সময় তিনি কারাগারে ছিলেন।
১৯৯৬ সালের ১৯ জুন দৈনিক পত্রদূতের প্র্রতিষ্ঠাতা বীরমুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন ঘাতকের গুলিতে শহিদ হন। স. ম আলাউদ্দীন হত্যার প্রতিবাদে জেলাজুড়ে ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়। অধ্যাপক আনিসুর রহিম ছিলেন সেই আন্দোলনের প্রথম সারিতে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র পত্রিকা এসময় সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি বারবার কলম ধরেছেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে সাতক্ষীরা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
এমআই