ডাঃ জোবায়ের আহমেদ :
আমি একজন মেয়ের বাবা।এটা আমার জীবনের অনন্য সুখকর একটা পরিচয়।
১৮ মাস বয়সী আমার জান্নাতের ফুল তার বাবাকে অল্প কয়দিনই কাছে পেয়েছে।তার সুন্দর জীবনের জন্য বাবাকে তার খুব প্রয়োজন।বাবার রাজকণ্যা হয়ে বাবার স্নেহের বটবৃক্ষের ছায়ায় সে বড় হতে চায়।
বাবার হাত ধরে সে আগাতে চায় সুন্দর জীবনের পথে।
আমরা চিকিৎসকরা মানুষের জন্য নিজ জীবন স্যাক্রিফাইসের ব্রত নিয়েই এই পেশায় এসেছি।আমাদের পেশাটি মানবিক।
হ্যাঁ জীবন পথের ব্যয় নির্বাহ করতে এবং পরিবার ও সংসারের দায়িত্ব পালনে আমাদেরও টাকার দরকার হয়।
কিন্ত আমাদের আত্মিক সুখের জায়গা হলো একজন অসুস্থ মানুষের সুস্থতার হাসি।।একজন মরণাপন্ন মানুষ যখন মৃত্যুর খুব কাছ থেকে জীবনের আলোতে ফিরে আসে, তখন আমরা কতটা সুখ পাই,আনন্দিত হই তা বুঝানো যাবেনা।
আমরা দেশের এই চরম সংকটে দায়িত্ব এড়াতে চাইনা।
পালিয়ে যেতে চাইনা।
আপনারা আমাদের কসাই বলে গালি দেন।
হ্যাঁ আমাদের অনেকে সেই গালি অর্জন করে নেয় তা অস্বীকার করবো না।
কিন্ত আপনাদের চরম বিপদের দিনে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমরাই থাকি আপনাদের পাশে।।
আমি ১৬ জন মানুষের একটা পরিবারের সব ব্যয় একা নির্বাহ করি।।
অভাবের দিনগুলি পেরিয়ে মা বাবা ভাই বোন পরিবার ও নিজ সন্তানকে সুন্দর জীবন দিতে আমি বিগত এগারো বছর নীরবে কাজ করে যাচ্ছি।
আমাদের জমি নাই ,ফ্লাট নাই, গাড়ি, বাড়ি নাই।
খুব সাধাসিধে জীবন আমাদের।
ব্যাংকের কাছে ও অনেক সুহৃদদের কাছে অনেক লোন।
আজ আমি মারা গেলে আমার পুরো ফ্যামিলিকে পথে নামতে হবে।
যেই স্বপ্নের পথে হেঁটে এত অধ্যাবসায় ও ত্যাগ করে এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি,তা আবার শুন্যতায় ভরে যাবে।
আমি আমার মা বাবার স্বপ্ন পূরণের কমরেড।
আমাকে হারালে আমার মা বাবা অসহায় হয়ে যাবেন।
চিকিৎসক হিসেবে আমি যেমন আমার দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল ও আন্তরিক, তেমনই পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে আমি আমার মা বাবা, ভাই বোন ও সন্তান,পরিবারের কাছেও দায়বদ্ধ।।
এই দায় আমি এড়াতে পারিনা কোনভাবেই।
দিনশেষে পরিবারই আমাদের শেষ ঠিকানা।শেষ আশ্রয়।
আমি ১১ বছর ধরে চিকিৎসা দিচ্ছি।
লাখো মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর কারিগর আমি।
কিন্ত আজ আমি আতংকিত।
কিন্ত আমারতো আতংকিত হবার কথা ছিলোনা।
করোনা ভাইরাসের মত মরণঘাতী ভয়ংকর অচেনা শত্রুর মুখোমুখি হয়ে লড়ে যাবার অদম্য সাহস আমার আছে।
আমার ভয় আমার পরিবার।
আমার ভয় আমার সন্তান।
আমার ভয় আমার বৃদ্ধ মা বাবা।।
তাদের জন্যই আমি এখন মরে যেতে চাইনা।
যদিও মৃত্যু অনিন্দ্য সুন্দর।
দেশের হাজার হাজার চিকিৎসক এর জীবনের গল্পটা আমার মতই।।
আমাদের দেশের চিকিৎসকরা অরক্ষিত।আমাদের কোন নিরাপত্তা নাই।।
ইতিমধ্যে ১৬৭জন চিকিৎসক মৃত্যুর বরণ করেছেন।
আমাদের নিরাপত্তার জন্য কতজন আওয়াজ তুলছেন?
যেই মানুষগুলো আপনার জন্য লড়ছে, সেই মানুষগুলোর নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য আপনি চুপ থাকতে পারেন,এমন স্বার্থপর আপনাকে আমি ভাবিনা।
ভারতে করোনা ভাইরাসের তান্ডব দেখে আমি আতংকিত।
আমি ভয় পাচ্ছি।
প্রতিদিন চেম্বারে কোভিড সাস্পেক্টেড রোগী পাচ্ছি।
মানুষ টেস্ট করতে চায়না।
মাস্ক পরেনা।
কোনকিছুর তোয়াক্কা নেই তাদের।
ইতিমধ্যেই কয়েকজন কোভিড পজেটিভ রোগীর সংস্পর্শে এসেছি আমি।
ভারতের ডাবল ও ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট এর তান্ডবে আমাদের চেয়ে উন্নত হেলথ সিস্টেম কলাপ্স করে গেছে।
লাশের স্তুপ।
শ্মশান ও কবরে লাশ দাহ করে ও কবরস্থ করে সামাল দেওয়া যাচ্ছেনা।
একটু অক্সিজেনের অভাবে হাহাকার করছে ভারত।
কিন্ত আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের ও সাধারণ মানুষের হুশ নেই।
একদিকে এমন ভয়াবহতার আশংকা, অন্যদিকে মানুষের ইকোনমিক ক্রাইসিস সব মিলিয়ে টিকে থাকাই দায়।
ভারতের এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে ঢুকে পড়লে কি হবে তা ভেবে আমি অত্যন্ত বিচলিত।
আমি শংকিত।
আমাদের দেশে এখনই অক্সিজেনের ঘাটতি আছে।
তারপর একটা বিধ্বংসী ও দ্রুত বিস্তার করা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে আমরাদের ভঙ্গুর হেলথ সিস্টেম কিভাবে সামলাবে তা বুঝে আসেনা আমার।
আমাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে।
চিকিৎসা পাবার অধিকার আছে।। কিন্ত আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাবার কি নিশ্চয়তা আছে?
একজন আইসিইউতে যাওয়া কোভিড রোগীর চিকিৎসা ব্যয় কত জানেন?
ব্যাংক লোনের কিস্তি দিতে পারিনা
আইসিইউ বিল কোথায় থেকে দিবো?
যত কথাই বলেন, আসুন নিজ জায়গায় সচেতন হই ও দায়িত্বশীল আচরণ করি।
আমরা সচেতন হয়েও টিকা নিয়েও আপনার লাগামহীন আচরণে আমরা আক্রান্ত হতে পারি।
আমরা মরে যেতে পারি অথচ আমাদের বাঁচাটা অনেকগুলো মানুষের জন্য খুব দরকার।
হ্যাঁ আপনাকেই বলছি।
মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানো এই ভাইরাসের বিস্তার আপনিই রুখে দিতে পারেন যদি আপনি সচেতন থাকেন।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন।।
অযথা শপিংমলে ভীড় না জমান।
সবশেষে আকাশ ও জমিনের মালিক মহান রবের নিকট প্রার্থনা করুন আল্লাহ যেন আমাদের হায়াতে তাইয়েবা দান করেন।