মহিউদ্দিন মোহাম্মদ: আপনি কী করেন? এ প্রশ্নটি যিনি করেন তার দিকে আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। এটি মোটেও নিরীহ কোনো প্রশ্ন নয়। প্রশ্নকর্তা একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এ প্রশ্নটি করেন, এবং উদ্দেশ্যটি অত্যন্ত অসৎ। তিনি নিশ্চিত হতে চান যে, আমি তার চেয়ে ক্ষমতাধর কেউ কি না। এ প্রশ্নটির উত্তরই নির্ধারণ করে, তিনি আমার সাথে কেমন ব্যবহার করবেন।
তিনি যদি বুঝতে পারেন আমি সাধারণ গফুর, আমার আয় সামান্য, আমি টেনেটুনে চলি, যাকে পাই তাকেই সালাম দিই, আমার পড়াশুনো কম, আমার কোট-টাই নেই, আমাকে কেউ স্যার ডাকে না, আমার আত্মীয়দের মধ্যে কেউ অস্ত্র বহন করে না, আমার ব্যাংক হিশাবে খরা লেগে আছে, আমাকে একটি চড় দিলে প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না— তাহলে তিনি খুব খুশি হন। তিনি নিরাপদ বোধ করেন, এবং নিজের কাজে মন দেন। আমার প্রতি তার আর কোনো কৌতুহল থাকে না। আমার ওজন তার কাছে এক লাফে শূন্যে গিয়ে ঠেকে।
কিন্তু যদি টের পান আমি বড় শিল্পপতি, আমি একটি মন্ত্রণালয় চালাই, একটি জেলার মালিকানা আমার ঘাড়ে, আমি অনেকগুলো সমিতির সভাপতি, আমি মানিক মিয়া এভিন্যুতে বকাবকি করি, অস্ত্রের সাথে আমার আত্মীয়তা আছে, আমাকে টিভিতে দেখা যায়, লন্ডন আমেরিকা নিয়মিত দৌড়ঝাঁপ করি, লোকজন আমাকে স্যার ডাকে, আমার নামের আগে মাননীয় বসানো হয়, ব্যাংক হিশাব নয়, আমার নিজেরই একটি ব্যাংক আছে— তাহলে তিনি লাফ দিয়ে উঠেন। চেয়ার এগিয়ে দেন, হাত বাড়িয়ে দেন, তোলপাড় করে তুলেন চারপাশ, এবং মনে মনে অনিরাপদ ও বিপন্ন বোধ করেন।
এর কারণ তিনি একটি সংকটে ভোগেন, এবং তার সংকটটি সরল নয়। তিনি একই সাথে ক্ষমতাকে পছন্দ ও ঘৃণা করেন। যদি তিনি ক্ষমতাকে শুধুই পছন্দ, কিংবা শুধুই ঘৃণা করতেন তাহলে তার এ সংকট হতো না। এমন কি ক্ষমতার প্রতি ভাবলেশহীন থাকলেও তার চলতো। তখন 'আমি কী করি', এ নিয়ে তাকে উদ্বেগে থাকতে হতো না। আমার ক্ষমতার অস্তিত্বও তাকে আলোড়িত করতো না। তিনি আমার সাথে করতে পারতেন সাধারণ ও স্বাভাবিক আচরণ।
কিন্তু একই সাথে প্রীতি ও ভীতিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি ক্ষমতাকে করে তোলেন গুরুত্বপূর্ণ। ফলে আগন্তুকের সাথে সাক্ষাতের শুরুতেই তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেন তার ক্ষমতা নিরূপণে।
কেন একজন মানুষ একই সময়ে ক্ষমতাকে পছন্দ ও ঘৃণা করেন? অথবা গুরুত্বহীন ক্ষমতাকে করে তোলেন গুরুত্বপূর্ণ?
এর প্রধান কারণ তিনি একটি রাষ্ট্রের বাসিন্দা। রাষ্ট্র তার উপর কিছু সংস্কৃতি আরোপ করে। একটি সংস্কৃতি হলো— রাষ্ট্র উৎপাদনকে উৎসাহিত করে। কিন্তু আপনি আপনার পরিবারের জন্য যতোটুকো প্রয়োজন ঠিক ততটুকো উৎপাদন করলে রাষ্ট্র খুশি হয় না। রাষ্ট্র খুশি হয় তখন, যখন আপনি আপনার প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন করেন। কারণ:
কেবল প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন করলেই আপনি কিছু পণ্য ও সেবা বিক্রি করবেন, এবং লিপ্ত হবেন বেচাকেনায়। রাষ্ট্র তার পরিচালনা খরচ আহরণ করে নাগরিকদের বেচাকেনা থেকে। যে-রাষ্ট্রে বেচাকেনা শূন্য, সে-রাষ্ট্র মৃত রাষ্ট্র। এ জন্য রাষ্ট্র চায় যেকোনো মূল্যে বেচাকেনা চালু রাখতে। এর সাথে রাষ্ট্র যারা চালায় তাদের আরাম-আয়েশের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
রাষ্ট্র প্রশংসা করে শুধু দুটি গোষ্ঠিকে—
এক: যারা অতিরিক্ত উৎপাদন করেন, এবং উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বেচাকেনা করেন। কৃষক, স্বর্ণকার, শিল্পপতি, দোকানদার, ট্রাভেল এজেন্সি, বেসরকারি চাকুরীজীবী, স্বাধীন পেশাজীবী, বেসরকারি ভোক্তা, এরা হলো এ শ্রেণীর নাগরিক। এ শ্রেণী ভোগযোগ্য সম্পদ সৃষ্টি করেন, এবং রাষ্ট্র পরিচালনার খরচের যোগান দেন।
দুই: যারা প্রথম গোষ্ঠির অতিরিক্ত উৎপাদন থেকে রাষ্ট্রের জন্য ট্যাক্স আহরণ করে তা খরচ ও অপচয় করেন। যে-রাষ্ট্র যতো উন্নত সে-রাষ্ট্রে অপচয় ততো কম ঘটে। দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাটও এ অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্র যারা চালান তারা এ শ্রেণীর নাগরিক। রাষ্ট্র কারা চালান? রাষ্ট্র চালান তারা যারা রাষ্ট্র থেকে বেতন নেন, কিংবা বেতনের সমতুল্য বৈষয়িক সুবিধাদি গ্রহণ করেন।
এই দুই শ্রেণীর মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রশংসা রাষ্ট্র সবসময় করে, এবং প্রথম শ্রেণীর প্রশংসা শুধুমাত্র শর্তসাপেক্ষে করে। শর্তটি হলো অতিরিক্ত উৎপাদন ও ভোগ। কোনো রাষ্ট্রে প্রথম শ্রেণীটি বিলুপ্ত হলে দ্বিতীয় শ্রেণীটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয়।
প্রথম শ্রেণীটি হলো রাষ্ট্রের আর্থিক যোগানদাতা, এবং দ্বিতীয়টি ওই যোগানকৃত অর্থের ভোক্তা ও পাহারাদার। রাষ্ট্র তার টিকে থাকার স্বার্থে দ্বিতীয় শ্রেণীটিকে প্রথম শ্রেণীর চেয়ে বাড়তি নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এ উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয় বৈষম্যমূলক আইন ও বিধি। দ্বিতীয় শ্রেণীর অনেকে ভোগ করতে থাকেন অতুলনীয় রাষ্ট্রীয় সুবিধা।
প্রথম শ্রেণীর নাগরিকেরা হয়ে থাকেন নিরস্ত্র (একমাত্র ব্যতিক্রম আমেরিকা, আমেরিকায় সাধারণ নাগরিকেরাও অস্ত্র বহন করতে পারেন), এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকেরা নিজে অস্ত্র বহন করেন অথবা অন্য অস্ত্রবাহকের দ্বারা সুরক্ষিত থাকেন। তবে প্রথম শ্রেণীর নাগরিকেরাও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের অস্ত্রের সুরক্ষা পান, যেমন পুলিশের, কিন্তু সেটিও নির্বিঘ্ন উৎপাদন ও বেচাকেনার স্বার্থে।
ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রথম শ্রেণীর নাগরিকদের মনে একটি হীনমন্যতার জন্ম হয়। হীনমন্যতা থেকে জাগে ক্ষমতাপ্রীতি ও ভীতি। তাদেরও লোভ জাগে, প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে যাওয়ার। শ্রেণীবদলের এ স্বপ্ন কারও কারও সফল হয়, কিন্তু অধিকাংশেরই সফল হয় না। কারণ দ্বিতীয় শ্রেণীর চেয়ে প্রথম শ্রেণী সংখ্যাবহুল, এবং দ্বিতীয় শ্রেণীতে লোকবলের চাহিদা কম। চাহিদার চেয়ে আগ্রহীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় তৈরি হয় জুতোক্ষয়ী প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে সরকারি চাকুরির জন্য যে-মরিয়া যুদ্ধ তার মূল কারণ প্রথম শ্রেণীর নাগরিকদের এই শ্রেণী পরিবর্তনের লোভ।
আবার প্রথম শ্রেণীর কিছু সদস্য খুব সহজে দ্বিতীয় শ্রেণীতে যেতে পারেন। যেমন- ধনী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, প্রভাবশালী টিভিমুখ, ও পেশাজীবী। উদাহরণ হিশেবে বাংলাদেশের সংসদের কথা বলা যায়। এ আইনসভার সিংহভাগ সদস্য ধনী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি।
যেহেতু অধিকাংশই শ্রেণী পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়, সেহেতু ব্যর্থ দ্বিতীয়শ্রেণীলোভী প্রথম শ্রেণীর নাগরিকেরা শুরু করেন ক্ষমতাকে ঘৃণা। এ ঘৃণার জন্ম হয় হিংসা থেকে। কিন্তু একই সাথে তারা ক্ষমতাকে ভালোও বাসতে থাকেন। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তরণের স্বপ্নকে তারা ভেতরে ভেতরে বাঁচিয়ে রাখেন।
মর্মান্তিক হলো, প্রথম শ্রেণী থেকে যারা দ্বিতীয় শ্রেণীতে সফলভাবে গমন করেন, তারাও সমানভাবে ভুগেন এ অসুখে। তারা আতংকে থাকেন, কে কখন এসে কেড়ে নিয়ে যায় তার ক্ষমতা।
এটি একটি সংকটময় পরিণতি। এ সংকট থেকেই কেউ কেউ আমাকে জিগ্যেস করেন— আপনি কী করেন?
জিগ্যেস করে নিশ্চিত হতে চান যে, তার ক্ষমতা আমি কেড়ে নেবো কি না।
তবে এ প্রশ্নের সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা। ইশকুলে গিয়েই তারা শোনে— তোমার বাবা কী করেন? শিশুরা নিজে যেহেতু কিছু করে না (যদিও আমি জানি শিশুরা অনেক কিছুই করে), তাই প্রশ্নকর্তা শিশুটির ক্ষমতা মাপতে চান শিশুটির বাবার ক্ষমতা দ্বারা। বাবার পেশা ও পরিচয়ই নির্ধারণ করে শিশুটিকে ইশকুলে কতোখানি সমীহ, ও কতোখানি অবহেলা করা হবে।
এটি শুধু ইশকুলে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ চর্চা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। যাদের জন্ম কৃষক ও শ্রমিক পরিবারে, তারা ‘তোমার বাবা কী করেন’ এ প্রশ্নে খুবই বিব্রত হন, এবং যাদের জন্ম স্যার পরিবারে, তারা এ প্রশ্নে খুব খুশি হন। এর কারণ কী?
এর কারণ রাষ্ট্রের আচরণ। রাষ্ট্র সবার সাথে একই আচরণ করে না। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, দোকানদার, ছোট উদ্যোক্তা, গরুর দালাল, ট্রাকচালক, মেথর, মুচি, রিকশাওয়ালা, রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, সবজি পাইকার, প্রাইভেট টিউটর, নাপিত, বাবুর্চি, নার্স, ভ্যানচালক, ফেরিওয়ালা, বাসচালক, ঝাড়ুদার, বিড়িওয়ালা, চৌকিদার, লেখক, তাদের সাথে রাষ্ট্রের আচরণ একরকম; আর মন্ত্রী, সাংসদ, রাষ্ট্রপতি, মেয়র, শিল্পপতি, উপাচার্য, গভর্ণর, সচিব, ডিসি, চেয়ারম্যান, ইউএনও, অভিনেতা, দালাল, ভাড়াটে লেখক, সাংবাদিক, ছদ্মকবি, আমদানীকারক, শিল্পী, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, বিউটিশিয়ান, বৈমানিক, পুলিশ, আর্মি, ন্যাভি, রাজনীতিক, অধ্যাপক, ঠিকাদার, ফায়ার সার্ভিস, ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যারিস্টার, বিচারপতি, বাবুল হুদা, সংঘবাদী, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, লিপস্টিক, ব্যাংকার, প্রশংসাকার, তাদের সাথে রাষ্ট্রের আচরণ অন্যরকম।
রাষ্ট্রের আচরণই এখানে নির্ধারণ করছে মানুষের সামাজিক নিয়তি। শিশুদের বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা বুঝতে পারে, তার বাবা-মা সমাজে গৃহীত না কি নিগৃহীত। সে যদি টের পায়, রাষ্ট্রের চোখে তার বাবা-মা একটি ভাঙা ছাতার সমান, তাহলে সে আর ইশকুলে ওই প্রশ্নটি শুনতে চায় না। এটি তার ভেতরে একটি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সে মনে মনে সংকল্প করে, আমাকেও তাদের মতো হতে হবে, যারা রাষ্ট্রের চোখে ভাঙা ছাতা নয়। এ সংকল্প শিশুটিকে নষ্ট করে ফেলে। সে আর সে থাকে না।
তার স্বাভাবিক প্রতিভাগুলো বিকৃত হতে শুরু করে। তার হয়তো ভালো লাগতো ঘুড়ি উড়ানো, কিন্তু তার আর ঘুড়ি উড়াতে ইচ্ছে করে না। সে ছবি আঁকা ছেড়ে দেয়, খেলাধুলো ছেড়ে দেয়, ছড়া লেখা ছেড়ে দেয়, গান গাওয়া ছেড়ে দেয়, প্রশ্ন করা ছেড়ে দেয়, তার যা যা করতে ভালো লাগতো তার সবই ছেড়ে দেয়। সে ধীরে ধীরে, মানুষ থেকে হয়ে উঠে প্রতিযোগী। সে অংশ নেয় শ্রেণী পরিবর্তনের একটি কুৎসিত ইঁদুর দৌড়ে।
এ দৌড়ে জয়ী হওয়া ছাড়া, তার সামনে আর কোনো বিকল্প থাকে না। সে জানে, বিয়ের সময়ও তাকে শুনতে হবে, আপনি কী করেন? তাই, এ প্রশ্নের একটি ভালো উত্তর খোঁজাই, শিশুটির জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
সময় জার্নাল/আরইউ