আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
নির্বাচনের আগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ক্ষমতায় এসে ইসরাইলের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, সর্বোচ্চ কঠোর হবেন। তিন বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। নেতানিয়াহু এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি একরোখা, নীতি বাস্তবায়নে নিচ্ছেন চরমপন্থা। সর্বশেষ তিনি গ্রহণ করেছেন বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাসের বিশাল উদ্যোগ।
আদালতে নেতানিয়াহুর ঘুষগ্রহণ, জালিয়াতি ও অর্থ তছরুপের তিনটি মামলার বিচারকার্য চলছে। এ বিচারকার্য তার ও সরকারের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সরকারের কর্তৃত্ব সুসংহত করতে তড়িঘড়ি করছেন নেতানিয়াহু। দেশটির নাগরিকরা এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে, তাই প্রতিবাদস্বরূপ তারা দখলে নিয়েছেন রাজপথ। দেশের ভেতরে শক্তিশালী বিক্ষোভের মধ্যেও তিনি একগুঁয়ের মতো তার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথে। পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীরে ইসরাইলি ইহুদিদের বসতি বিস্তার ও অবৈধ ইহুদি স্থাপনাগুলোর বৈধতা দিচ্ছেন। বলপ্রয়োগ করে তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি পাচ্ছেন তার উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় উগ্রবাদী জোট সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থন। তিনি মনে করছেন, জাতীয় ঐক্য, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার আওয়াজ তুলে পশ্চিম তীরে ইহুদি আবাসন স্থাপন তার অজনপ্রিয় হওয়া ঠেকাতে পারে। এর ফল হিসেবে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন—উভয়পক্ষেরই লোকজনের রক্ত ঝরবে, হামলা ও পালটা হামলার ঘটনা ঘটতে পারে—এমনটি অনুমান করা হয়েছিল। এখন তাই-ই হচ্ছে।
সন্দেহভাজন ইসলামি জঙ্গি রয়েছে—এ অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার দখলিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিনের একটি শরণার্থী শিবিরে আচমকা অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ব্যাপক পরিসরের এ অভিযানে ১০ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনায় চালানো হয়েছে ধ্বংসলীলা। ঐ রাতে গাজাতেও কমপক্ষে ১৩ বার বিমান হামলা চালানো হয়। গত রবিবার পর্যন্ত চলতি বছর ইসরাইলি বাহিনীর হাতে নিভে যায় ৩২ ফিলিস্তিনির প্রাণ। গাজা ও পশ্চিম তীরের বাসিন্দারা এখন চরম আতঙ্কে করছেন দিনাতিপাত। মাত্র ৫ মাস আগে, ইসরায়েলি হামলায় ৪৯ জনের মৃত্যুর শোক এখনো কাটেনি।
এদিকে, কথার ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে ইসরাইলের দুশমনির জবাব দিচ্ছে হামাসসহ কয়েকটি সংগঠন। ধারণা করা হচ্ছে, জেনিনকাণ্ডের বদলা নিতে গত শনিবার দখলিকৃত জেরুজালেমের বাইরে বন্দুক হামলায় দুই ইসরাইলি জখম হয়েছেন। এর আগের দিন জেরুজালেমের বাইরে একটি সিনেগগের কাছে হামলায় মারা গেছে সাত জন।
ফিলিস্তিনের ব্যাপারে বস্তুত ইসরাইল এখন হার্ডলাইনে। এটি স্পষ্ট হয়েছে, গত ৩ জানুয়ারি কট্টর ডানপন্থি নেতা নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গ্যভিরের জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ চত্বর পরিদর্শনের সময়ই। মসজিদটি সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে তৃতীয় পবিত্র স্থান। স্থিতাবস্থা বা স্ট্যাটাস কৌ জারির ফলে এখন শুধু মুসলিমরাই পারেন মসজিদে প্রার্থনা করতে। অন্যদিকে ইহুদিরাও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যেতে পারেন ওখানে। তবে পারেন না সেখানে প্রকাশ্যে প্রার্থনা করতে।
ঘটনার পরপরই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়েছে। ইসরাইলি বাহিনী কীভাবে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে, তা খতিয়ে দেখতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে সাধারণ পরিষদ। এ ছাড়া দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে ইসরাইলি নীতিমালার বৈধতার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও আল-আকসা মসজিদের স্ট্যাটাস কৌ বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসংঘের এসব আহ্বানে নেতানিয়াহু সরকার আরো কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়। সর্বশেষ নিজেদের নিরাপত্তায় ইসরাইলিরা সহজে আগ্নেয়াস্ত্রের অধিকার পাবেন বলে প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী। এর আগে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের দল ফাত্তাহর কয়েক জন শীর্ষ নেতার পশ্চিম তীরে প্রবেশ সুবিধা বাতিল করে। ইসরাইলি বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের সাহায্যের জন্য বরাদ্দ ৩৯ মিলিয়ন ডলার আটকে দেয়। এমনকি আল-আকসা মসজিদের দেখভাল করে যে জর্ডান, সে দেশটিরও এক প্রতিনিধিকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি মসজিদে। এসব কার্যক্রম গাজা ও পশ্চিম তীরকে ঘিরে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখে আসছিল ফিলিস্তিনিরা, তার ওপর নির্মম কুঠারাঘাতেরই শামিল।
জেনিনে অভিযানের পর আল ফাত্তাহ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন সভা করেছে। সিদ্ধান্ত হয়, ইসরাইলের সঙ্গে আর নিরাপত্তা সমন্বয় করা হবে না। হামাসসহ অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে একত্রে যুগপৎ কর্মসূচি চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়টি জাতিসংঘে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উঠানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ইসরাইলের এসব পরিকল্পনা তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইউক্রেন যুদ্ধে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে নতুন করে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। অধিকৃত এলাকায় নতুন কোনো অবকাঠামো নির্মাণের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে, বিশেষত ঐ অঞ্চলে ইরানের আধিপত্য ঠেকাতে ইসরাইলের সঙ্গে চমত্কার বোঝাপড়া রয়েছে দেশটির। বাইডেন প্রশাসন তাই কোনোভাবেই বিশ্বস্ত বন্ধু নেতানিয়াহুকে চটানোর ঝুঁকি নেবে না। নিন্দা জানানো বা দেবে না কোনো কড়া বার্তা। ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যপ্রাচ্য সফরে অধিকৃত এলাকার স্ট্যাটাস কৌ বজায় রাখার ব্যাপারে পুনরায় আহ্বান জানাবে। অন্যদিকে, মুসলিম কয়েকটি দেশের সঙ্গে ইসরাইলের করা আব্রাহাম চুক্তিও দেশটিকে আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভার রেখেছে। এ কারণে সেসব দেশ থেকে আগের মতো আর কোনো জোরালো প্রতিবাদ আসার সম্ভাবনা দেখে না ইসরাইল।
জেনিনে অভিযানের পর, ইতামার বেন গ্যভির, ইসরাইলি বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, যারা আমাদের সঙ্গে লাগতে আসবে, তাদেরকে এর খেসারত দিতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে, ফিলিস্তিন ইস্যুতে নরম হবে না, বরং হার্ডলাইনে থাকবে ইসরাইল।
এমআই