নিজস্ব প্রতিবেদক:
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনলাইনে ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচির আগে আজ সোমবার ঢাকায় বাসে আগুন দেওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ১৩ নভেম্বর, অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের এ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, রাজধানীতে ইতিমধ্যে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার থাকবেন অন্তত ১৭ হাজার পুলিশ সদস্য। পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করার কথা রয়েছে ১৩ নভেম্বর। ওই মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি (পুলিশের মহাপরিদর্শক) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন (অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী)। জুলাই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় এটিই প্রথম মামলা, যেটির রায় ঘোষণার তারিখ জানানোর অপেক্ষায় রয়েছে।
কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে আওয়ামী লীগের পেজসহ নেতাদের পেজে ১৩ নভেম্বর ‘লকডাউন’ কর্মসূচি পালনের কথা বলা হচ্ছে। পুলিশও কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে তাদের কর্মসূচি প্রতিহত করতে ঢাকায় অভিযান ও তল্লাশি চালাচ্ছে। এরই মধ্যে চোরাগোপ্তা হামলার কয়েকটি ঘটনা ঘটে। আজ ঢাকায় তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয় এবং সাতটি জায়গায় অন্তত ১০টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী আজ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকাতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়েছে। কর্মসূচি পালনে রাস্তায় বের হলেই গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে এ মুহূর্তে বড় কিছু করা সম্ভব নয়। অপ্রীতিকর কিছু করবে—এমন কোনো আশঙ্কাও নেই।
বাসে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণ
বাসে আগুন দেওয়ার একটি ঘটনা ঘটে আজ সন্ধ্যার পর ধানমন্ডির মিরপুর রোডে ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে। পুড়ে যাওয়া বাসটি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এতে হতাহতের কোনো ঘটেনি। এর আগে আজ ভোরে আধঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকার বাড্ডা ও শাহজাদপুর এলাকায় যাত্রীবাহী দুটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতেও কেউ হতাহত হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষে কর্তব্যরত কর্মকর্তা রাশেদ বিন খালেদ বলেন, সোমবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে গুলশানের শাহজাদপুর এলাকায় যাত্রীবাহী ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসে এবং বাড্ডার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সকাল সোয়া ছয়টার দিকে আকাশ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস খবর পেয়ে গিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে।
রাজধানীর মিরপুর ও ধানমন্ডির দুটি করে জায়গায় এবং বাংলামোটর, মোহাম্মদপুর ও খিলগাঁওয়ের একটি করে জায়গায় মোট ১০টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। চারটি জায়গাতেই মোটরসাইকেলে হেলমেট পরে আসা ব্যক্তিরা ককটেল ছোড়ে। দুটি জায়গায় কে বা কারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তা জানা যায়নি।
পুলিশ জানায়, সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে খিলগাঁও উড়ালসড়কের ওপরে দুর্বৃত্তরা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে মিরপুর-১০ নম্বর শাহ আলী মার্কেটের সামনে পরপর তিনটি ককটেলের বিস্ফোরণ হয়। পুলিশ বলেছে, এতে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
রাতে রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এনসিপি এক বার্তায় জানিয়েছে, রাত ১১টায় বাংলামোটরে এনসিপি কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। এ সময় পাঁচটি ককটেল মারা হয়, যার মধ্যে একটি বিস্ফোরিত হয়নি। ককটেল মেরে মোটরসাইকেলযোগে পালানোর সময় নিক্ষেপকারী দুজনকে ধাওয়া দিয়ে ধরেন এনসিপির নেতা–কর্মীরা। তাদেরকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। পরে সন্দেহভাজন আরও তিনজনসহ মোট পাঁচজনকে আটক করেছেন এনসিপির নেতা–কর্মীরা। সবাইকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে।
এর আগে সকাল সাতটার দিকে মোহাম্মদপুরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারের খাদ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠান প্রবর্তনার সামনের সড়কে ও সীমানার ভেতরে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। দুই দুর্বৃত্ত হেলমেট পরে মোটরসাইকেলে এসে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান বলে জানিয়েছেন প্রবর্তনার এক নিরাপত্তাকর্মী। এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. ইবনে মিজান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন) ক্যামেরার ভিডিও চিত্র বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
এছাড়া ভোর পৌনে চারটার দিকে মিরপুর–২ নম্বরের গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেলে এসে দুই দুর্বৃত্ত এ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তাদের মাথায় হেলমেট ছিল। চেহারা বোঝা যায়নি। তবে দুজনকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
এ ছাড়া আজ ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মাইডাস সেন্টারের সামনে দুটি এবং ইবনে সিনা হাসপাতালের সামনে দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। দুটি জায়গাতেই মোটরসাইকেলে হেলমেট পরে এসে ককটেল ছোড়া হয়।
ঢাকার বাইরে সোমবার রাতে মানিকগঞ্জে একটি স্কুলবাসে আগুন দেওয়া হয়। রোববার দিবাগত রাতে নেত্রকোনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) প্রীতম সোহাগের বাড়ির ফটকে আগুনের ঘটনা ঘটে।
ঢাকায় শুক্রবার রাত পৌনে ১১টার দিকে কাকরাইলের সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল এবং ওই দিন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফ স্কুল প্রাঙ্গণে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আজ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, রাজধানীতে সম্প্রতি ককটেল হামলার ঘটনায় ২৮ বছর বয়সী এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে তাঁকে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজধানীর সব গির্জা এবং সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আন্তধর্মীয় ঐক্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছে।
নিরাপত্তা জোরদার
সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোববার আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত কোর কমিটির এক বিশেষ সভায় আওয়ামী লীগের ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে শনিবার ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত পুলিশের বৈঠকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, মিছিল বা সমাবেশ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে তাঁদের কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকাতে ১৩ নভেম্বর ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনাগুলোতে ১৭ হাজার পুলিশ সদস্য সক্রিয় থাকবেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবেন সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র্যাব, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বিপুলসংখ্যক সদস্য।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের পর রোববার রাত থেকে ঢাকায় ঢোকার পথসহ বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তাচৌকি বসিয়ে যানবাহন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি শুরু হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে পুলিশের টহল। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বেআইনি কর্মকাণ্ড চালানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় অবস্থান করতে পারেন—এ আশঙ্কায় আবাসিক হোটেল, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হোস্টেল, মেস ও বস্তিতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। গণপরিবহনে সাদাপোশাকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং পায়ে হেঁটে, মোটরসাইকেল ও গাড়িতে করে বহুমাত্রিক টহল চলছে। সম্ভাব্য ককটেল প্রস্তুতকারীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের জড়ো হওয়ার আহ্বান জানানো পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। রোববার আওয়ামী লীগের স্লোগান-সংবলিত এক লাখ গ্যাস বেলুন উড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করার পরিকল্পনার অভিযোগে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপি। তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার আশপাশে এই বেলুন ওড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এদিকে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৩৪ নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডিএমপি জানিয়েছে, এর মধ্যে ঝটিকা মিছিলে অংশ নেওয়া এবং এর পরিকল্পনাকারী ও অর্থায়নকারীরা রয়েছেন।
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম আজ রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অপপ্রচার শুনে জেলা পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যাতে ঢাকায় আসতে না পারেন, সে ব্যাপারে প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তল্লাশিচৌকি, টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ
ডিএমপি আজ এক গণবিজ্ঞপ্তিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন, বিচারপতি ভবন, জাজেস কমপ্লেক্স, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটক, মাজার গেট, জামে মসজিদ গেট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১ ও ২–এর প্রবেশ গেট, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ভবনের সামনে সব ধরনের সভা, সমাবেশ, গণজমায়েত, মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। নাগরিকেরা এগিয়ে এলে এসব চোরাগোপ্তা ককটেল হামলা ঠেকানো সহজ হবে।
একে