আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
পারভেজ মোশাররফ, পাকিস্তানের সাবেক চার তারকা জেনারেল। যিনি ১৯৯৯ সালে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর প্রায় এক দশক ধরে দেশ শাসন করেছেন। তার শাসনামলে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখেছে পাকিস্তান। রক্ষণশীল একটি মুসলিম দেশে সামাজিকভাবে উদার মূল্যবোধের সূচনা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
রোববার পাকিস্তানের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, স্বেচ্ছানির্বাসনে কয়েক বছর কাটানো পারভেজ মোশাররফ দীর্ঘদিনের অসুস্থতায় ভুগে রোববার সংযুক্ত আরব আমিরাতে মারা গেছেন। পাকিস্তানের ক্ষমতায় বেশ কয়েক বছর বিপুল সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি।
তবে ক্ষমতায় থাকাকালীন জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর চরম হুমকির মুখোমুখিও হয়েছিলেন পারভেজ মোশাররফ। দেশটিতে সক্রিয় এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা তাকে অন্তত তিনবার হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল।
কিন্তু ভিন্নমত দমনে সামরিক বাহিনীর ব্যাপক ব্যবহার ও একই সাথে আল-কায়েদা এবং আফগান তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অব্যাহত সমর্থন শেষ পর্যন্ত মোশাররফকে পতনের দিকে নিয়ে যায়।
পারভেজ মোশাররফের জন্ম ভারতের বর্তমান রাজধানী নয়াদিল্লিতে, ১৯৪৩ সালে। নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর যখন মুসলিমদের গণহারে পাকিস্তানমুখী যাত্রা শুরু হয়, তখন মোশাররফের পরিবারও সেই যাত্রায় নাম লেখায়। আর সেই সময় মোশাররফের বয়স ছিল মাত্র চার বছর। তার বাবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন আর মা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তার পরিবার আধুনিক, মধ্যপন্থী এবং সহনশীল ইসলামের চর্চা করতো।
১৮ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন পারভেজ মোশাররফ। এই বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আগে পাকিস্তানের এলিট কমান্ডো ইউনিটের নেতৃত্বও দেন তিনি। অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসেন পারভেজ মোশাররফ।
ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরে এক সামরিক অভিযান পরিচালনার সবুজ সংকেত দেওয়ার কারণে নওয়াজ শরিফ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় এই অভিযান ঘিরে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল পাকিস্তান-ভারত। আর সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফকে চাকরিচ্যুত করার চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারাতে বাধ্য হন নওয়াজ শরিফ।
সরকারের একেবারে শুরুর বছরগুলোতে সংস্কারবাদী পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হন তিনি। ক্ষমতায় আসার পরপরই তিনি নারীদের অধিকার রক্ষায় আইন পাস এবং দেশটিতে প্রথমবারের মতো সংবাদভিত্তিক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদন দেন।
ই-সিগারেট আর আমদানিকৃত হুইস্কির প্রতি ঝোঁক এবং মুসলমানদের ‘আলোকিত মধ্যপন্থার’ জীবনধারা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১/১১’র হামলার পর পশ্চিমে পারভেজ মোশাররফের গ্রহণযোগ্যতাকে ব্যাপক বাড়িয়ে তোলে।
২০০৬ সালের এক স্মৃতিকথায় মার্কিন ক্রোধ থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর কৃতিত্ব নিয়েছিলেন পারভেজ মোশাররফ
ওই হামলার পর ওয়াশিংটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের একজনে পরিণত হন পারভেজ মোশাররফ। শুধু তাই নয়, মার্কিন সামরিক বাহিনীকে পাকিস্তানের মাটিতে গোপন ঘাঁটি বসিয়ে সেখান থেকে সশস্ত্র ড্রোন হামলা চালানোর অনুমতি দেন তিনি। মার্কিন ড্রোন হামলায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পাশাপাশি পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আফগান সীমান্ত লাগোয়া উপজাতীয় এলাকায় দেশটির সেনাদের অভিযান চালানোর নির্দেশও দেন তিনি।
আর এসবই বিদেশে তার ক্ষমতায় থাকাকে গ্রহণযোগ্য কিংবা বৈধ করে তুলতে সহায়তা করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানকে স্থানীয় চরমপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে নিমজ্জিত করতে সাহায্য করেছিল। ২০০৬ সালের এক স্মৃতিকথায় তিনি মার্কিন ক্রোধ থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর কৃতিত্ব নিয়েছিলেন। সেই সময় ওয়াশিংটনের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি না করলে ‘প্রস্তর যুগের মতো বোমা হামলার জন্য প্রস্তুত’ থাকতে হবে; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে এভাবে সতর্ক করে দিয়েছিল বলে দাবি করেছিলেন তিনি।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে অর্থ ঢালতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশের সাথে লবিংয়ে সফল হয়েছিলেন তিনি। তারপরও পাক সেনাবাহিনীর আনুগত্য কখনই দ্ব্যর্থহীন ছিল না। সেনাবাহিনীর শক্তিশালী গোয়েন্দা শাখা তালেবান এবং আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
পররাষ্ট্রনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন পারভেজ মোশাররফ। ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরুর তিন বছরের কম সময়ের মধ্যে ২০০২ সালে আঞ্চলিক এক সম্মেলনে বিশ্বকে চমকে দেন পারভেজ মোশাররফ। ওই সম্মেলনে বক্তৃতা শেষ করার পর তিনি আকস্মিকভাবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর দিকে এগিয়ে যান এবং তার সঙ্গে হস্তমর্দন করেন। শুধু তাই নয়, সেই সাক্ষাতেই তিনি বাজপেয়ীকে দুই দেশের মাঝে শান্তি আলোচনা শুরুর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলেন, ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের শক্তিশালী বিরোধের কেন্দ্রে থাকা কাশ্মির সংকট— মোশাররফের শাসনামলে সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু সেই শান্তি প্রক্রিয়া তার শাসনামলের পরপরই লাইনচ্যুত হয়ে যায়।
পারভেজ মোশাররফের শাসনামলে পাকিস্তানে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। দেশটির বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে পৌঁছায়। বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় তিন দশকের মধ্যে ওই প্রবৃদ্ধির হার ছিল পাকিস্তানের সর্বোচ্চ।
তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পারভেজ মোশাররফের শেষ বছরগুলোতে তার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যাপক আকার ধারণ করে। যা তার আগের সব সাফল্যকে মাটিচাপা দেয়। ২০০৬ সালে দেশটির বেলুচিস্তান প্রদেশে সামরিক অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন তিনি। ওই সময় সেনাবাহিনীর অভিযানে বেলুচিস্তানের উপজাতীয় এক নেতার প্রাণহানির মধ্য দিয়ে সেখানে সশস্ত্র এক বিদ্রোহের বীজ বপন হয়; যা আজও অব্যাহত আছে।
পরের বছর দেশটিতে শরিয়া আইন চালুর দাবিতে আন্দোলন শুরু করে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীকে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন পারভেজ মোশাররফ। পরে ইসলামাবাদের একটি মসজিদে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। এতে শতাধিক ছাত্র নিহত হয়।
স্বেচ্ছানির্বাসনে কয়েক বছর কাটানো পারভেজ মোশাররফ দীর্ঘদিনের অসুস্থতায় ভুগে রোববার সংযুক্ত আরব আমিরাতে মারা গেছেন আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশটিতে নতুন সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) জন্ম হয়। এই জঙ্গিগোষ্ঠীর চোরাগোপ্তা হামলা, আত্মঘাতী বোমা হামলায় দেশটিতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
২০০৭ সালে পাকিস্তানে আত্মঘাতী এক হামলায় দেশটির তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেনজির ভুট্টো নিহত হন। দেশটিতে নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে তার নেওয়া পদক্ষেপ দেশটিতে বিক্ষোভের সূত্রপাত করে। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় নির্বাচন স্থগিত করে এবং দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন মোশাররফ।
১১ বছরের মধ্যে পাকিস্তানে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে। মোশাররফের রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে হেরে যায় এবং সংসদে অভিশংসনের মুখোমুখি হন তিনি। পরে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে লন্ডনে পালিয়ে যান এক সময়ের প্রতাপশালী এই স্বৈরশাসক।
সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসেন পারভেজ মোশাররফ। কিন্তু সেই নির্বাচনে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। ২০১৬ সালে দেশ ছেড়ে দুবাইয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় তাকে। ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির দায়ে পাকিস্তানের একটি আদালত ২০১৯ সালে তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করে। যদিও পরবর্তীতে আদালতের এই রায় বাতিল করা হয়।
এমআই