ডা. জোবায়ের আহমেদ :
কাল রাতে যখন ঘটনাটি জানি, তখন স্তব্ধ হয়েছিলাম। কিছুক্ষণ।
মেয়েটিকে দেখে বারবার আমার ছোটবোন আফসানার চেহারা চোখে ভেসে উঠছিলো।
বাচ্চা একটা মেয়ে কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।
আমার বোন সীমার বিয়েতে আফসানা ও সীমার বান্ধবী গুলো আমাকে ধরলো,তারা আমার সাথে ছবি তুলবে।
তাদের আমার মত একজন ভাই নেই কেন সেটা নিয়ে তাদের আবেগ দেখেছি।
কোন মানুষ পরিপূর্ণ নয়।আমিও নই।
সবারমতো আমারও নানা দোষ,ত্রুটি,সীমাবদ্ধতা আছে।
কিন্ত বোনদেরকে ভালবাসার যেই হৃদয় সমুদ্র আমার আছে তা অনেকেরই আমি আজকাল দেখিনা।
একজন বড়ভাই মানে অনেক দায়িত্ব।
বোনদের আগলে রাখা,তাদের সরল পথে পরিচালিত করা,তাদের পাশে থেকে মায়া ও ভালবাসার পরশে জড়িয়ে রাখা।
মুনিয়া আমার কুমিল্লার মেয়ে।
তাদের বাসার সামনের উজির পুকুর পাড় দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করেছি।
মেয়েটির জন্য একজন বড়ভাইয়ের জায়গা থেকে অনেক স্নেহ ও মায়া অনুভব করছি।
মেয়েটিকে আমি কোন দোষ দিবো না।
মেয়েটির বাবা মা কেউ দুনিয়ায় বেঁচে নেই।
মেয়েটির বড়ভাই এর সাথে দু'বোনের বিরোধ ও দূরত্ব ছিলো সেজন্য তারা কেউ বাবার বাসায় আসতেন না।
দীর্ঘদিন বড়ভাই এর সাথে মেয়েটির কথাও হয়নি।
বিপদের শংকায় মেয়েটি বড়বোনকেই কাছে ডেকেছে।
ক্লাস নাইনে পড়ার পর মেয়েটি ঢাকায় যেতে হলো কেন তার উত্তর খুঁজে পাইনি আমি।
কুমিল্লায় এত ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকতে ঢাকায় গিয়ে কলেজে পড়ার দরকার কি ছিলো?
মা বাবা হারা মেয়েটাকে তার বড়ভাই বড়বোন আগলে রাখেননি।
বড়বোন তার পাশে থাকলেও বড়ভাই কোন খবরই রাখেননি।
অথচ এত ছোট্ট মেয়েটাকে বড়ভাই সন্তানস্নেহে লালন পালন করার কথা ছিলো।
এখানে মেয়েটির ভাগ্য ও বড়ভাইয়ের দায়িত্বহীনতা স্পষ্ট।
আমি তো বিয়ে দেওয়ার পরেও আমার বোনদের কোন ব্যাপারে উদাসীন হতে পারিনা।
আমাদের সমাজটা এমন ছিলো না।
কেন এই সমাজ একজন বড়ভাইকে তার এতিম বোনকে আগলে রাখার দায়িত্ব নিতে শিখায়নি তা আমি জানিনা।
মেয়েটির বড়বোন সব জানতো।
এই বছরের মার্চ মাসে যখন গুলশানের এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেওয়া হয় তখন বড়বোন ও বোনজামাই এর আইডি কার্ড ব্যবহার করেছে।
বড়বোন ভেবেছেন এত বিশাল বড়লোকের সাথে বোনের প্রেম ও বিয়ের হাতছানি, এত টাকা,দামী দামী জামাকাপড়, ঘড়ি, ব্যাগ, কসমেটিক্স, উন্নত জীবন, বোন ভালই থাকবে,সেও দায়িত্ব মুক্ত হতে পারবে ।
কিছুটা সুবিধা সেও পাবে।
নিজের ঘাড়ের বোঝা দূর করতেই বড়বোনটি মেয়েটির ব্যাপারে দূরদর্শিতা দেখায়নি।
নিজ সংসার ও সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত চাকুরীজীবী বড়বোন কি মা বাবা মরা ছোটবোনকে পালতে পারতেন না?
এই দুনিয়ায় তাকে রক্ষায় তার কি কোন দায় ছিলো না।
স্বার্থপর এই ভোগবাদী সমাজে মুনিয়া বড় অসহায় ছিলো।
দুইজন ভাইবোনের কেউ তার দায়িত্ব নেয়নি।
যদি তারা দায়িত্ব নিতো,তবে আজ তাকে লাশ হতে হতো না।
বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি এইদেশের মহাপরাক্রমশালী একজন মানুষ।
অতীতেও এমন খুন তারা হজম করতে পেরেছিলো।
এই পরিবারের হাতে অনেক মানুষ নিগৃহীত হয়েছে,লুন্ঠিত হয়েছেন।
আগের খুনের শাস্তির মুখোমুখি হলে আজ এই সাহস আসতো না।
যেহেতু মামলা হয়েছে, দেখাযাক কতদূর গড়ায় পানি।
আইনের শাসন যেখানে আছে, সেখানে আইনের চোখে সবাই সমান।
যেকোনো অন্যায়, জুলুম, অবিচার, প্রতারণার প্রতিকার মানুষ আইনের কাছে চায়।
আইন ন্যায়বিচার দিয়ে মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামিয়ে দেয়।
কিন্ত আমাদের দেশে আইন সবার জন্য সমান নয়।
আইনে ন্যায় বিচার পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার।
আমাদের দেশের মানুষ অদ্ভুত ভাবে বুঝে যায় কোনটার বিচার হবে, কোনটার বিচার হবেনা।
কারণ টাকার পাহাড় ও রাজনীতি জড়িত যখন।
টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দেওয়া যায়,সবাইকে কিনে নেওয়া যায়।
এখানে সবাই নিজে বিক্রি হতে অপেক্ষা করে।
আমাদের দেশের মানুষ যারা বিভিন্ন চেতনা লালন করেন, তারা আদতে ভন্ড ও বদমাইশ শ্রেণীর।
তাদের অনুভূতি সবার জন্য সমানভাবে জাগেনা।
এক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মাসুদা ভাট্টি নামের এক মহিলাকে চরিত্রহীন মনে করায় তাকে জেল খাটতে হয়েছে।
অনেক মামলা দিয়ে তাকে নাস্তানাবুদ করা হয়েছে। টকশোতে, মানববন্ধনে গলা ফাটিয়ে তার মুন্ডুপাত করা হয়েছে।
অথচ এই দেশে একজন বড়লোক নিতান্তই সাধারণ ফ্যামিলির একটা মেয়েকে কিভাবে নাজেহাল করেছে, বারবার চোর চোর চোর বলে অপবাদ দিয়েছে, খানকি,মাগী বলে গালি দিয়েছে, মেয়েটা কান্না করে বারবার বলছে সে টাকা চুরি করেনি,কই দেখলাম তো কারো দরদ মেয়েটার জন্য।
আমাদের মিডিয়াপাড়া অনেক আগেই তাদের বিবেক বিক্রি করে এমন বড়লোকদের কাগুজে রক্ষিতা হয়ে গেছে।
পেশাদারী আচরণ, দায়িত্বশীলতা,ন্যায়নিষ্ঠতা, নির্ভীক সাহসিকতা ও নিরপেক্ষতা তাদের থেকে আশাকরা বাতুলতা।
তারা এখন কে কার থেকে কতবড় তেলবাজ, চাটুকার ও দালাল তা প্রমাণে ব্যস্ত।
তারা আমাদের নীতিজ্ঞান দেয় অথচ তারা সবচেয়ে বড় ভন্ড ও মুখোশধারী।
বিজ্ঞাপনের কাছে,কচকচে টাকার বান্ডিলের কাছে তারা তাদের আত্মা বিক্রি করে বসে আছে।
মুনিয়া বিচার পেতে হবে।
মুনিয়ার সাথে হওয়া অন্যায়ের সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে।
টাকার পাহাড় থাকলেই কেউ কারো জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারেনা, তা প্রমাণ করতে হবে।
আমি আজ নিজেও একজন মেয়ের বাবা।
আমি বলবো আপনার ছেলে ও মেয়েদের মূল্যবোধ শিক্ষা দিন।
তাদের সাদাসিধে জীবনের সাথে অভ্যস্ত করান।
তাদের কঠোর অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজ পায়ে দাঁড়াতে শিখান।
নিজ সন্তানদের মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্বশীলতার অনুশীলন শেখান।
আর কারো সন্তান যেন মুনিয়ার মত পোড়াকপালি না হয় সেই শুভকামনা জানিয়ে গেলাম।