আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
তুরস্ক ও সিরিয়ায় শক্তিশালী ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এরই মধ্যে দেশ দুটিতে নিহত হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ। হাজার হাজার বিধ্বস্ত ভবনের নিচে এখনো বহু মানুষ আটকে রয়েছেন। তাদের অনেকেই এখনও বাঁচার আশা দেখছেন। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে তাদের বাঁচার আশা ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
জীবিতদের উদ্ধারের আশায় উদ্ধারকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্ধশতাধিক দেশ থেকে উদ্ধারকারীরা তুরস্ক ও সিরিয়ার কার্যক্রমে যোগ দিয়েছে। বৈরী আবহাওয়া, সড়ক ধসেপড়া এবং ভারী যন্ত্রপাতির অভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছানো ও সেখানে উদ্ধারকাজ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অর্ধলক্ষাধিক উদ্ধারকর্মী দিনরাত চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্কের ১০টি শহরের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিরিয়ায় উদ্ধার অভিযানে সমস্যা বাড়তে শুরু করেছে। রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তুরস্ক থেকে সেখানে জাতিসংঘের জরুরি সাহায্য পাঠানোর পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
এছাড়া এসব এলাকায় অক্ষত থাকা বাড়িঘরেও বাসিন্দাদের প্রবেশ না করতে নির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসন। কারণ আবারও বড় ভূমিকম্প হতে পারে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সহায় সম্বল হারানো এসব মানুষ রাস্তায় বা গাড়িতে রাত কাটাচ্ছেন। তাদের পরিস্থিতিও অনেক মানবেতর।
বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদদাতা অ্যানা ফস্টার তুরস্কের ওসমানিয়া শহর থেকে ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা দিয়েছেন। শহরটি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছেই। বৃষ্টির কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। রাতে শহরটিতে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না। প্রবল শীতের মধ্যে দুর্গতরা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন। কয়েকদিন ধরে তুরস্ক ও সিরিয়ার জনগণের চোখে ঘুম নেই।
আটকেপড়া ব্যক্তিদের আত্মীয়রা ধ্বংসস্তূপের পাশে অপেক্ষা করছেন। তাদের আশা, স্বজনদের হয়তো জীবিত খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তীব্র শীতের কারণে উদ্ধার প্রচেষ্টা কঠিন হয়ে উঠেছে। গৃহহীনদের দুর্দশা বেড়েছে। বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নেই।
ইস্তাম্বুলের তুর্কি সাংবাদিক ইব্রাহিম হাসকোলোলু বলেন, লোকরা এখনো ধসেপড়া ভবনের নিচে রয়েছে, তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আটকেপড়া লোকজন তাকে ও অন্য সাংবাদিকদের ভিডিও, ভয়েস নোট এবং তাদের লাইভ অবস্থান পাঠাচ্ছে। তারা আমাদের বলছে, তারা কোথায় আছে এবং আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া লোকদের বের করে আনতে যত দেরি হবে, তাদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা তত কমে আসবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির জরুরি সেবা বিশেষজ্ঞ ড. রিচার্ড এডওয়ার্ড মুনের মতে, পানি ও অক্সিজেনের স্বল্পতাই ভুক্তভোগীদের বেঁচে থাকার পথে প্রধান বাধা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীর থেকে দৈনিক ১ দশমিক ২ লিটার পর্যন্ত পানি বেরিয়ে যেতে পারে। এটি ঘটতে পারে প্রস্রাব, নিঃশ্বাস, জলীয়বাষ্প ও ঘামের মাধ্যমে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া লোকদের শরীর থেকে এরই মধ্যে প্রচুর পানি বেরিয়ে গেছে। এ অবস্থায় একজন মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ওপর, সিরিয়া-তুরস্কে এখন চলছে শীতকাল। একজন গড়পড়তা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীর উষ্ণ থাকার ক্ষমতা না হারিয়ে সর্বনিম্ন ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে।
তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, জোরালো ভূমিকম্পে সাড়ে ১১ হাজারের মতো ঘরবাড়ি-স্থাপনা ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে এখন পর্যন্ত ৩২ হাজার মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো।
এদিকে উদ্ধারকাজের ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ভূমিকম্পের পর প্রাথমিকভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, সেসব নিতে দেরি হচ্ছে—এমন অভিযোগ তাদের।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও উদ্ধারকাজে ধীরগতির এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করেছেন। গতকাল কাহরামানমারাস শহরে যান এরদোয়ান। তখন সেখানে পুরোদমে উদ্ধারকাজ চলছিল। এ সময় এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ভূমিকম্পের কারণে সড়ক ও বিমান যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকাজের গতি বাড়বে।
উদ্ধারকাজে ধীরগতির চিত্র দেখা গেছে সিরিয়াতেও। দেশটির উত্তরাঞ্চলের শহর জানদারিসের একটি ভবনে ৩২টি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। এই ভবনের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বেঁচে গেছেন। তারা বলেন, ভূমিকম্পের পর এখান থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধারকাজের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার, সেগুলো না থাকায় কাজ ধীরে চলছে।
জাতিসংঘে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের পর দ্রুত উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য তার সরকারের সক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান গৃহযুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকায় সিরিয়া এই সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
এমআই