আরিফ আহমেদ: সংকট-সংগ্রামে, দুর্দিন-দুর্বিপাকে তথা জাতির ক্রান্তিলগ্নে ও মানবিক বিপর্যয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে এগিয়ে আসা সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংগঠনটি আলোর মশাল হাতে সকল আঁধার আলোকিত করে নবসূর্য্যের দ্বীপ্ত প্রদীপে মুক্তির শপথ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সময়ের প্রয়োজনেই ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির স্লোগানে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যুগযুগ ধরে আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া প্রাণের এই সংগঠন।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় করোনা মহামারী মোকাবেলায় শুরু থেকেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ অভিভাবক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সুযোগ্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জনাব আল-নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে মহামারীর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে অসহায় মানুষের সেবার্তে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ছাত্রলীগের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী মুখে হাসি বুকে বল নিয়ে বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানুষের কাঁধে হাত রেখে গেয়ে চলেছে মানবতার জয়গান।
মহামারীর এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জরুরি স্বাস্থ্যসেবার নিমিত্তে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের চিকিৎসক নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত টিম নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এই সেবাটি। এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উদ্যোগে ঢাকা মহানগরীর অসহায় মানুষের জন্য ‘দেশরত্ন মেডিসিন সার্ভিস’ চালু করা হয়েছে। নির্ধারিত নম্বরে কল করলেই ঔষুধ সেবা পৌঁছে যাবে রোগীর গৃহে। ‘হ্যালো ছাত্রলীগ’ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে করোনাক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ্যাম্বুলেন্স পরিসেবা চালু রয়েছে।
উল্লেখ্য, গেল বছরের করোনার প্রথম ঢেউয়ে ‘হ্যালো ছাত্রলীগ’ সেবা চালু হয় এবং ‘হ্যালো ছাত্রলীগ’ এপস এর মাধ্যমে মহামারীর প্রথম ঢেউয়ে দুই লক্ষাধিক মানুষ স্বাস্থ্য সহায়তা পেয়েছে। করোনা প্রতিরোধে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ডিসইনফেকশন চেম্বার ও মেডিকেল বুথ স্থাপন করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আরেকটি অনন্য উদ্যোগ হলো ‘বিনামূলে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’। ছাত্রলীগের তিন উদ্যমী নেতার উদ্যোগে এই সেবা চালু হয়। ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার’ মাধ্যমে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার করোনা আক্রান্ত রোগী সেবা পেয়েছেন বলে জানা যায়, যা সত্যিই গৌরবের বিষয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ জনবান্ধব কর্মসূচি হিসেবে অসহায় মানুষের জন্য রমজান মাসব্যাপী বিনামূল্য সেহরি ও ইফতারের আয়োজন করে। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মানুষের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে ইফতার ও সেহরি। মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি, পলাশীর মোড় যেন অসহায় মানুষের নির্ভরশীল নীড়ে পরিণত হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতাদের ভালবাসায় সিক্ত হচ্ছেন অগণিত অসহায় মানুষ।
‘আপনার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’-এই স্লোাগানকে প্রতিপাদ্য করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ‘বিনামূল্যে শিশুর জন্য গুড়া দুধ সরবরাহ কার্যক্রম’ চালু করেছে। করোনা মহামারীর এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ের সময়ে আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের যেসকল শিশুরা মায়ের দুধের অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে তাদের জন্য ছাত্রলীগের এই অনিন্দ্য প্রয়াস।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বপ্রথম চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ, ২০২০ সালে। এরপর একে একে বাড়তে থাকে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
বাংলাদেশে ভাইরাসটি সংক্রমণের শুরু থেকেই মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করে দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। মহামারির শুরুতে যখন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত অতীব জরুরী হয়ে পড়ে ঠিক তখনই শুরু হয় জনসচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ। সেই সাথে পাড়ায়-মহল্লায়, গ্রামে গঞ্জে, শহরে, নগরীতে চলতে থাকে জনসচেতনতামূলক মাইকিং।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য চারদিকে যখন জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজারের হাহাকার তখন ছাত্রলীগের সুযোগ্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সরাসরি তত্বাবধানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরী করে ঢাকা শহরের সাধারণ জনতার মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের দেখানো পথে সারা বাংলাদেশের শত শত ইউনিট ও লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরী করে সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় বিনামূল্যে পৌঁছে দেয়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ে অর্থাৎ মার্চ মাস থেকে জুলাই পর্যন্ত ৪ লক্ষ ৬৮ হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ঠিক একই সময়ে সারা বাংলাদেশে বিনামূল্যে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার মাস্ক বিতরণ করা হয়। পরবর্তীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। এছাড়া সাধারণ জনগণের মাঝে বিনামূল্যে বিপুলসংখ্যক জীবাণুনাশক সাবান ও হ্যান্ড ওয়াশ বিতরণ করা হয়। সেই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হাত ধৌত করার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার মানুষের মাঝে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সার্জিকেল মাস্ক, হ্যান্ডস্যানিটাইজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে।
করোনার প্রথম ঢেউ আসার কিছুদিন পরেই বাংলাদেশে শুরু হয় বোরো মৌসুমের ধান কাটা। মহামারীর কারণে প্রচন্ড রকমের শ্রমিক সংকট দেখা দেয় হাওরাঞ্চলসহ সারাদেশে। যথাসময়ে ফসল ঘরে তুলতে না পারার আশঙ্কায় কৃষক যখন চরম দুর্ভোগে ঠিক তখনই জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাঠে নেমে যায় লক্ষ লক্ষ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। হাতে কাস্তে নিয়ে কৃষকের তরে ছুটে যায় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। সৃষ্টি হয় এক অনবদ্য ইতিহাস। শুধু ধান কেটেই ক্ষান্ত হননি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা, তারা কৃষকের ফসল মাড়াই করে ঘরে তুলে দিতেও সহযোগিতা করেছেন। অনেক জায়গায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হারবেস্টার মেশিন চালিয়ে সহযোগিতা করেছেন কৃষকদের। সারাদেশে প্রায় ৯৬ হাজার শতাংশ জমির ফসল কাটায় সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। একই সময়ে শ্রমিক সঙ্কটে ভুগতে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের লবণচাষী ও ভুট্টা চাষীদের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্থ ২৫ টি জেলার বিভিন্ন এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তা, ব্রিজ মেরামত সহ প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষকে ত্রাণ দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
গেল বছর, ভাসমান মানুষ ও পথশিশু সহ নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত লাখ লাখ মানুষের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। খাদ্য সহয়তা থেকে শুরু করে শিশুখাদ্য, মৌসুমী ফল, সেহরি, ইফতার ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী ঈদ উপহার হিসেবে বিতরণ করা হয়। মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঢাকা শহরসহ সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষার্থীদের মেস ও বাসা ভাড়া সংক্রান্ত নানা জটিলতায় পড়তে হয়। শিক্ষার্থীদের এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
‘ফ্রী সবজি বাজার'’ ছিল ছাত্রলীগের অনন্য উদ্যোগ। কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে শাক-সবজি ক্রয় করে করোনায় সর্বশান্ত মানুষের মাঝে বিনামূল্যে তা বিতরণ করা হয়। চট্টগ্রামে শুরু হওয়া এই মানবিক ‘ফ্রী সবজি বাজার’ একসময় দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে সারাদেশের হাজার হাজার অসহায় মানুষ উপকৃত হয়।
করোনা মহামারিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মানবিকতার অনন্য নজির স্থাপন করে। করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশ যখন অবহেলায় অযত্নে পড়ে থাকে, আপন স্বজনরা যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন এগিয়ে আসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। নির্দয় মানবের ভীতসন্ত্রস্ত সমাজে ভয়হীন অদম্য ছাত্রলীগ মানবিক হৃদয়ের ভালবাসার উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভয়কে জয় করে করোনাক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশের দাফনকার্য সম্পন্ন করে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে ৬০ জন মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যা পরবর্তীতে অব্যাহত ছিল।
বৈশ্বিক করোনা মহামারির এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি সারাদেশে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা পূর্বের ন্যায় অসহায় কৃষকের ধান কেটে দেয়া, মাস্ক বিতরণ, ইফতার ও সেহরি বিতরণ, এ্যাম্বুলেন্স সরবরাহ, টেলিমেডিসিন সেবাসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সুস্থ্য স্বদেশের স্পৃহায় যৌবনের সমস্ত উচ্ছ্বাস নিয়ে অসহায় মানুষের কাঁধে হাত রেখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সমস্বরে গেয়ে যাবে-
‘আমরা তো আছি ভয় কী বন্ধু, জেগে উঠো পদাতিক,
ছাত্রলীগ, জয় জয় ছাত্রলীগ।’
মানবের তরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জয়গান অব্যাহত থাকুক।
লেখক: স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক উপ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সময় জার্নাল/আরইউ