চন্দ্রিকা চক্রবর্তী: বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পালিত দিবসটি হলো মে দিবস। একে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও অভিহিত করা হয়। প্রতি বছর মে মাসের প্রথম তারিখে সারাবিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ এই ঐতিহাসিক দিবসটি পালন করা হয়। মে দিবস আজ লক্ষ শ্রমিকের আপসহীন সংগ্রামের কথা বলে। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার দুর্বার আন্দোলনের রক্তস্রোতে বিজড়িত ইতিহাসের কথা বলে
প্রতিটি সমাজে সবসময় শ্রমের শোষণের বিরুদ্ধে জোর সংগ্রাম বজায় ছিলো। তবে সেই সংগ্রামের পথ কখনও মসৃণ ছিলো না। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিলো নানা ঘাত-প্রতিঘাত, জুলুম, অত্যাচার। সেই সূত্র ধরে বলতে গেলে এটাও উঠে আসে যে, মে দিবস একদিনেই আন্তর্জাতিক চেহারা পায়নি। এর পিছনে রয়েছে রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। সেই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এমন একটা সমাজব্যবস্থা এককালে বিরাজ করতো, যেখানে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের কাছ থেকে ১৬-১৮ ঘন্টার শ্রম আদায় করে নিতো। এভাবে শ্রম নামক অমানবিক নির্যাতন সেই শ্রমিকেরা মেনে নিতে পারেনি। যেটা খুবই স্বাভাবিক। একসময় প্রতিবাদ গড়ে উঠে সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং সেই প্রতিবাদ ক্রমান্বয়ে রূপ নেয় বিপ্লবে।
আমেরিকার শ্রমিকেরা সর্বপ্রথম ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ১৮৮০ সালে। পরবর্তীতে দৈনিক শ্রম ৮ ঘন্টা নির্ধারণের দাবিতে ১৮৮৪ সালে মালিকের কাছে প্রস্তাব দেয়। সেই প্রস্তাবনা মূলত ছিলো ৮ ঘন্টা শ্রম, ৮ ঘন্টা ঘুম আর ৮ ঘন্টা বিনোদন এর জন্য। আর প্রস্তাবটি কার্যকর হওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের পহেলা মে পর্যন্ত। কিন্তু তাদের প্রস্তাব সেই সময়ের মধ্যে কার্যকর না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষাধিক শ্রমিক নেমে পড়ে রাস্তায় আন্দোলন শুরু করার জন্য। তখনই ঘটে এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। তাদের ন্যায্য দাবি পূরণ করা দূরে থাক, উল্টো তাদের বিচারের নামে গ্রেফতার এমনকি হতাহতও করা হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই দাবি তখন ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। অবশেষে সেই শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়া হয় এবং সেইসাথে বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিক অধিকার।
১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে মে দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৮৯০ সালে গ্রেট ব্রিটেনের হাউড পার্কে প্রথম আন্তর্জাতিক মে দিবস উদযাপিত হয়। ১৮৯৬ সালে রাশিয়ায় এবং ১৯২৪ সালে চীনে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মে দিবস পালন করা হয়।
এখন বাংলাদেশেও মে দিবসে সরকারি ছুটি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা বাণী দেওয়া হয়। শ্রমিকেরা রঙিন ফেস্টুন নিয়ে মাথায় হরেক রঙের কাপড় বেঁধে শোভাযাত্রায় বের হয়। শিকাগোতে ঘটে যাওয়া সেই মে মাসের ঘটনা ব্যক্ত করে নানা সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। টেলিভিশন ও বেতারে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। মে দিবস উপলক্ষে শ্রমিক সংগঠনগুলো থেকে আয়োজিত হয় বিভিন্ন প্রকারের সাংস্কৃতিক ও কল্যাণমুখী কর্মসূচি। এক কথায়, আনন্দঘন পরিবেশে এ দিনটি কাটে এদেশের শ্রমিকদের জন্য। কারণ তারা এদিনে তাদের নিয়মিত কাজ থেকে কিছুটা হলেও অব্যাহতি পেয়ে থাকে।
মে দিবস দুনিয়ার শ্রমিকদের এক হওয়ার ব্রত। মে দিবসের মাধ্যমেই সেই সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যেই পরিবর্তনের কারণে শ্রেণি বৈষম্যের বেঁড়াজাল থেকে শ্রমিকেরা মুক্ত হয়েছে। বিলোপ ঘটেছে পুঁজিবাদী দাসত্বের। কেননা, এমন একটা সময় ছিলো যখন পুঁজিবাদীরা শ্রমিকদেরকে নিজেদের দাস মনে করতো। কিন্তু এখন সেই হীন মানসিকতা অনেকটাই বিলুপ্ত হয়েছে শ্রমিক দিবসের কল্যাণে। বলা যায়, শ্রমজীবীরা একটা নতুন জীবন লাভ করেছে এর মাধ্যমে কারণ শ্রমিক-মালিকে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের প্রতি অবিচারেরও অবসান ঘটেছে এখন।
এই দিবসটির তাৎপর্যপূর্ণ অবদান আজকে শ্রমিক শ্রেণিকে আগলে রেখেছে। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এখন শ্রমজীবীদের ভূষণ। মে দিবসে সকল শ্রমজীবী মানুষ তাদের মধ্যকার পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করুক এবং ভবিষ্যতেও আরো অনেক উন্নয়নমুখী পরিবর্তনের সূচনা করুক এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখিকাঃ চন্দ্রিকা চক্রবর্তী, শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।