শাহ্ আলম, নিকলী থেকে ফিরে ::
মেয়ে সোনালীকে ছাগলগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গোয়াল ঘরে গাভী-বাছুরের যত্ন নিচ্ছেন আল্পনা আক্তার। স্বামী নুরু মিয়া মেজ ছেলেকে নিয়ে ভুট্টা ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত। ছোট মেয়ে স্বপ্না উঠানে ছাটাই বিছিয়ে পড়তে বসেছে। পাশে দলবেঁধে খেলছে শিশুরা।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার কাশিপুর গ্রামের এক বসন্ত বিকেলের দৃশ্য এটি। একসময়ের অবহেলিত, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপাঞ্চল এখন কর্মচঞ্চল মানুষের পদচারণায় মুখর। মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে তাদের মাঝে ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য স্পৃহা। বর্ষায় ভিটেমাটি ছাড়ার তাড়না ভুলে ডুবো শহরে জীবনের জাল বুনে চলছে তারা।
একান্ত আলাপচারিতার মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আল্পনা আক্তার কল্পনায় হারিয়ে যান জীবনের অতীত ইতিহাসে। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, এখন থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে বন্যা ও ভাঙনে বিলীন হয়ে যায় তার শৈশবের প্রিয় গ্রাম কাশিপুর। তারপর থেকে বছরের প্রায় ৬-৭ মাস গ্রামটি পানিতে তলিয়ে থাকে। গ্রামে তখন ৩১৫টি পরিবার বাস করতো। সর্বনাশা আফাল (ঝড়ের সময় উত্তাল হাওরে যে ঢেউ ওঠে) তাদের নিঃস্ব করে দেয়। বসতভিটা হারিয়ে ঠাঁই নেন পাশের গ্রামে। শুরু হয় জলে ভাসা পদ্মের ন্যায় শেকড়হীন বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
এ অবস্থায় ২০১৭ সালে সুদিনের দেখা পায় আল্পনা। তার মতো ভিটেমাটি ও পেশা হারানো মৎস্যজীবীদের ঘরে ফেরার স্বপ্ন পূরণে কাজ শুরু করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের হাওর অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবনমান উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প।
আল্পনা জানান, অবিশ্বাস্যভাবে আবারো জেগে উঠে কাশিপুর। ধীরে ধীরে নিজেদের পেশায় ফিরতে শুরু করে গ্রামবাসী। বলেন, আগে বর্ষাকাল আমাদের আতঙ্কিত করে তুলত, ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যেত। পরিবারসহ গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে আমরা পাশের উপজেলা করিমগঞ্জের ইন্দ্রায় চলে যেতাম। পানি শুকিয়ে গেলে আবার কাশিপুরে ফিরে আসতাম। এখন উঁচু করে বসতভিটা নির্মাণের ফলে বর্ষাতেও আমরা এখানে থাকতে পারি। এখন আর যাযাবরের ন্যায় বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে হয় না।
দুই রুমের ছোট্ট একটি ঘরে পরিবার নিয়ে আল্পনাদের বসবাস। পাশেই গবাদি পশু রাখার আরেকটি ঘর। ২টি গরু, ৫টি ছাগলসহ কিছু হাস-মুরগি পোষেণ বলে জানান তিনি। স্বামী শুকনো মৌসুমে বিলে চাষাবাদ করেন, বর্ষায় হাওরে মাছ ধরেন। সন্তানেরা স্কুল থেকে ফিরে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেন। সন্ধ্যায় সবাই মিলে কখনো টিভি দেখেন, গল্প করেন। এলজিইডির হাওর অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে জীবনে অর্থ খুঁজে পেয়েছেন আল্পনা। বলেন, এখন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি।
এ গল্প শুধু একজন আল্পনার নয়; একই প্রকল্পের মাধ্যমে ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন মশিউর, মজিবুর, জোহরা, কামিনা, আহেদ আলী, নূর ইসলাম, নবী হোসেন ও হেলাল মিয়াসহ আরো অনেকে। তাদের বেশির ভাগই পেশায় মৎস্য ও কৃষিজীবী। এদের কেউ শুটকি তৈরি ও বিপণন কাজে জড়িত, কেউ কাপড় সেলাইয়ে যুক্ত। আবার কেউ কেউ পশুপালন কিংবা দিনমজুর খেটে জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্তমানে তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার পাশাপাশি মিলেছে স্থায়ী ভিটায় স্বচ্ছন্দ্যে বসবাসের নিশ্চয়তা।
প্রকল্পের উপকারভোগী আবদুল খালেক বলেন, এক সময় বসতভিটা হারিয়ে আমরা পরিচয়হীন হয়ে পড়ি। স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও মৎস্যজীবী পরিচয়পত্র দেয়া হতো না। মাছ ধরার অধিকার হারিয়ে আমরা অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করতে থাকি। এলজিইডির মাধ্যমে আমাদের ভাগ্য খুলে যায়। ধীরে ধীরে নিজেদের পেশায় ফিরতে শুরু করি। আমরা নিজ উদ্যোগে বিলে একটি স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরি করেছি। ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক পরিবার নিজ গাঁয়ে নতুন করে বসবাস শুরু করেছে। আরও ১২০-১৫০টি পরিবার আসার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তাদের জায়গা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আবদুল করিম জানান, বিল ব্যবহারকারী সংগঠন (বিইউজি) নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিলের ইজারামূল্য পরিশোধ করাসহ নিয়মিত সঞ্চয় জমা ও মাসিক সভায় বিল ও গ্রাম উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সংগঠনের একটি নিজস্ব ব্যাংক হিসেব রয়েছে, যেখানে সদস্যদের সঞ্চয় জমা করা হয়।
বিইউজি সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, এইচএফএমএলআইপি প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তুহারা মৎস্যজীবীদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফিরেছে। বিলের বাকি অংশ খনন করে গ্রামের দক্ষিণ পাশ ভরাট করে দিলে আরও অন্তত ১৫০টি পরিবার সেখানে বসবাসের সুযোগ পাবে। এছাড়া শিশুদের জন্য ভাল মানের স্কুল ও স্থায়ী গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রয়োজন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাকিলা পারভিন বলেন, কাশিপুরের মৎস্যজীবীরা তাদের পুরোনো পেশা ফিরে পেয়েছে। বিলে কৃষিকাজ ও পশু পালন করে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সরকারের নানামুখি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে হাওরে শান্তির সুবাতাস বইছে।
উপজেলা উপ-সহকারী প্রকৌশলী আশীষ রোয়াজা বলেন, হাওর অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় আঠারবেকি ফাইল্লা বিলের পাশেই মিঠামইনের কামালপুর-শান্তিপুর-সিংপুর এলাকায় ৬ দশমিক ১২৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে কৃষকরা খুব সহজে হাওরের ফসল ও মাছসহ উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে পারছে। জনসাধারণ ও শিক্ষার্থীদের উপজেলা ও জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। এতে এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে।
এলজিইডির কিশোরগঞ্জ জেলা সমন্বয়কারী অফিসার শহীদুল ইসলাম বলেন, সমাজভিত্তিক জলমহাল ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিলটি কাশিপুরের প্রকৃত মৎস্যজীবীদের লিজ দেয়া হয়। গ্রামের ৩২ জন পুরুষ ও ১১ জন নারীসহ সর্বমোট ৪৩ সদস্য নিয়ে বিইউজি করা হয়। প্রকল্পের আর্থিক সহায়তায় আঠারবেকি ফাইল্লা বিল ও ৬৫০ মিটার বিল সংযোগ খাল পুনঃখনন করা হয়েছে। খননকৃত মাটি দিয়ে প্রায় ৩ একর জায়গা উঁচু করে বসতভিটা তৈরি করা হয়। সেখানে বর্তমানে ১৫০টি পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। কাশিপুরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে আরও টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ চলছে। সম্মিলিতভাবে কাজ করায় তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. রায়হান সিদ্দীক বলেন, হাওরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। হাওরাঞ্চলের রাস্তাঘাট উন্নয়নের ফলে যাতায়াত ও কৃষি পণ্য পরিবহন সহজ হয়েছে। উঁচু করে বসতভিটা তৈরি করে দেয়ায় বর্ষাকালে বসতভিটা ছেড়ে তাদের অন্য কোথাও যেতে হচ্ছে না। জলমহালগুলি প্রকৃত মৎস্যজীবীদের কাছে হস্তান্তর করে তাদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তারা জলমহাল পরিচালনার মাধ্যমে লভ্যাংশ ভোগ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন বলেন, হাওর অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পটি হাওর অধ্যুষিত পাঁচটি জেলা নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এলজিইডির সুনামগঞ্জ কমিউনিটি ভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের অপরিসীম সফলতার ফলোআপ প্রকল্পই হচ্ছে ‘হাওর অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয়ে চলতি বছর তথা ২০২৩ সালে প্রকল্পটি শেষ হবে।
তিনি বলেন, এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় দিকটি হলো মৎস্য ব্যবস্থাপনা। হাওর অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো বিল। সময়ের ব্যবধানে বিলগুলোতে কোন উন্নয়ন না হওয়ায় এটি কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে দেখা যায় অর্ধেক বিল। নেই মাছের উৎপাদন, কোন ধরনের অভয়াশ্রম। এছাড়া জীববৈচিত্র্যের জন্য আগে বিলগুলিতে যে হিজল-করচ গাছ ছিল তা অনেকাংশে উজাড় হয়ে গেছে। সেগুলোকে পুনরায় আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া, মাছের অভয়াশ্রম তৈরি করা, বিলগুলো পুনঃখনন করা, মাছের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা, খাল খনন করে বিলের সাথে বিলের সংযোগ স্থাপন করা, এসব কাজই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।
তিনি আরও বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাথে এলজিইডি মন্ত্রণালয় একটি চুক্তির মাধ্যমে মৎস্যজীবীদের বিলগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী মাছ চাষের সুযোগ করে দেয়া হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের সংঘবদ্ধ করে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা করা হয়। ইতোপূর্বে যেখানে বছরে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার মাছ আহরণ করা হতো। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ফিশের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই বিলগুলোতে এখন বছরে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার মাছ আহরিত হচ্ছে। হাওর অঞ্চলের জীবনমান উন্নয়নে আমাদের এই প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তারা এখন খুব সহজে স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে, শিশুরাও স্কুলে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়নের আরেকটি মাইলফলক হচ্ছে হাওর অঞ্চলের গরিব মানুষের অভাবনীয় উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে স্বপ্ন দেখেন ‘গ্রাম হবে শহর’, আমরা সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে কাজ করছি।
সরেজমিনে হাওর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বর্ষার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হাওরের জমিতে এখন ধান, শীতকালীন সবজি, ভুট্টা ও সূর্যমুখীর বাগান করেছেন কৃষকরা। সড়ক থেকে দৃষ্টি যতদূর যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ। মাঠে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে মহিষ ও গরুর পাল।
এলজিইডির পানি সম্পদ কার্যক্রম ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় সন্তোষ প্রকাশ করেন হাওরবাসী।
সময় জার্নাল/এসএ