ডা. ফাহমিদা মাহবুবা বন্যা :
রুপা ! পেশায় ডাক্তার ।সদ্য ইন্টার্নিশীপ শেষ করে একটা নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালের সার্জারি ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে।
সারাদিন এত কাজের প্রেশারে নিজের দিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত নেই ।রোগী দেখা..ফ্রেশ অর্ডার করা..ওটি এসিস্ট করা সাথে তো আছেই প্রফেসর স্যার দের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা রাউন্ডে দাঁড়িয়ে থাকা ।
রোগী গুলোও বলিহারি !এত যত্ন করে এত সময় নিয়ে হিস্ট্রি নেয় রুপা তবুও প্রফেসর স্যার দের সামনে এমন হিস্ট্রি দিবে যেটা শুনে আকাশ থেকে পড়ে সে ! স্যার রাও কটমট করে ওর দিকে তাকায় ।
রুপা পুরোই বেক্কল হয়ে যায় ।এমন না যে সে ফাঁকিবাজি করেছে..!আসলেও বলে না রোগী রা।একবার তো এক স্যারের কাছে ওয়ার্ড ভর্তি লোকের সামনে এমন বকা খেয়েছে যে ওর দু:খে ডাক্তারি প্রফেশন ছেড়ে ভাতের হোটেল দিতে ইচ্ছে করছিল ।
রাউন্ড শেষে রুপা ফের আবার ঐ রোগী কে জিজ্ঞেস করেছিল - আচ্ছা মা..আপনি তো আমাকে এই নতুন সমস্যার কথা বলেন নাই.. আমি অনেক বার করে জিজ্ঞেস করেছি.. এখন স্যারের সামনে কেন বললেন?আসলেই কি এই সমস্যা আছে আপনার ?
রোগী একগাল হেসে উত্তর দিয়েছে- হুনো গো বেডি! .বড় ডাকতর আইলে সমস্যা বাড়াইয়া বাড়াইয়া কইতে হয়.. তাইলে না ভালা ওষুধ দিব... ভালা ওষুধে তাত্তারি ভালা হইয়া যামু.. আমি বাড়িত যাইতে গা চাই. .এহানে হাসপাতালে আমার ভালা লাগে না...!
রুপা নির্বাক !! এই ঘটনা স্যার কে বললে স্যার তো বিশ্বাস করবেনই না উল্টো রুপা কে আরো বকবেন ।
স্যারের যেদিন ওটি থাকে সেদিন রুপার জান বের হবার যোগাড় হয়। একটার পর একটা ননস্টপ করতেই থাকেন।প্রতিবার ওয়াশ নিয়ে রুপাকেই দাঁড়াতে হয় এসিস্টে ।পা গুলো ব্যথায় টনটন করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে.. হাত গুলো যেন অবশ হয়ে যায় ইন্সট্রুমেন্ট ধরে থাকতে থাকতে। যদি সেকেন্ডের জন্যও কোন ইন্সট্রুমেন্ট ধরাটা একটু আলগা হয় সংগে সংগে স্যার ধমকিয়ে উঠেন ...এই মেয়ে, খেয়ে আসোনি ??
রুপা আরো সচেতন হয়ে যায় ।মনে মনে ভাবে - এই প্রফেসরদের আল্লাহ্ পাক কি দিয়ে বানাইছেন ? বয়স হয়ে গেছে কিন্তু এত ধৈর্য্য আর এত যত্ন নিয়ে এক একটা অপারেশন করেই যাচ্ছেন । অপারেশন থিয়েটারে এক একজন সার্জন যে কি করেন সেটা কখনোই বাইরের মানুষরা বুঝবেন না !
৫/৬ টা অপারেশনের পর স্যারের একটু দয়া হয় ।রুপা কে একটু ছুটি দেন চা খাওয়ার জন্য ।
স্যার যখন রোগী দেখেন তার আগেই রুপা কে সব রোগীর হিস্ট্রি নিয়ে রাখতে হয় ।হিস্ট্রি নিয়ে ভাইটাল সাইন দেখে পরে রোগীকে পাঠানো হয় স্যারের চেম্বারে ।
এবং প্রতিটা রোগীর বেলায়ই রুপা কে ডাকেন স্যার ।বলেন- চোখ দেখে রোগীর অবস্থা বর্নণা কর !
রুপা যেটাই বলে সেটাতেই স্যার লাগান ধমক ।এইটা কি বললা? এটা এভাবে হয় নাকি?
অনেক ধমক খেয়ে শেষ পর্যন্ত রুপা বুঝতে পেরেছে স্যার জানতে চান-
রোগীর জন্ডিস আছে কিনা
রোগীর সায়ানোসিস আছে কিনা
রোগীর রক্তস্বল্পতা আছে কিনা
রোগীর পানিশূন্যতা আছে কিনা
আগের কোন অপারেশনের হিস্ট্রি আছে কিনা
চোখের লোকাল কোন অসুস্থতা যেমন- কনজাংটিভাইটিস, স্টাই, ক্যালাজিয়ন আছে কি না
এখন রুপা শুধু এগুলোতেই ফোকাস করে।প্রতিটি রোগীর চোখই রুপা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে । স্যার বলেন- শোন রুপা, ঐ গান টা শুনছো না? চোখ যে মনের কথা বলে...আসলে ঐটা ঠিক না! চোখ শরীরের কথা বলে । চোখ দেখেই তুমি বুঝতে পারবা রোগীর আসল সমস্যা কোন জায়গায় । চোখ ডাক্তারদের জন্য রোগ নির্নয়ের পথ প্রদর্শক !
রুপা মাথা নাড়ে !
প্রফেসর আবজাল চৌধুরী ।শহরের নামকরা সার্জারি বিশেষজ্ঞ। যেমন তার মেজাজ গরম তেমনি তার দয়ার শরীর। কোন কোন রোগীর বেলায় তিনি একটাকা ছাড় দিতেও রাজি না আবার কোন কোন রোগীকে অপারেশন করে দেন একদম বিনামূল্যে ।এবং নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ওষুধ পর্যন্ত কিনে দেন ।মাঝে মাঝে রুপা বুঝতেই পারে না ঘটনা কোনদিকে গেল ! কোন কোন রুগীর কাছে স্যার সাক্ষাত ভগবান ! আর কারো কারো কাছে পাক্কা কসাই !
রুপা ভেবে রেখেছে স্যারের যখন মেজাজ ভাল থাকবে একদিন সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করে নিবে এর পিছনের কারণ । কোন কোন ক্রাইটেরিয়া মিট করলে রোগীরা ফ্রি সার্ভিস পান আবার ঠিক কোন ক্রাইটেরিয়ার জন্য এক টাকাও ছাড় নেই । কিন্তু স্যার কে দেখেই তো রুপার গলা শুকিয়ে আসে । সবসময় তো ধমকের উপরেই রাখেন ওকে । কোনদিন স্যার কে এটা জিজ্ঞেস করা হবে কিনা এ ব্যাপারে রুপা নিজেই সন্দিহান ।
স্যারকে সকালে হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে যান তার ছেলে । আবার ডিউটি শেষে নিয়েও যান । স্যারেরও গাড়ি আছে কিন্তু তার ছেলে এই কাজটা ভালবাসা নিয়ে করে বলে তিনি আর আপত্তি করেন না ।
ছেলের নাম পলাশ । এটুকুই জানে রুপা ।
সেদিন এক নার্স বলছিলো - স্যারের ছেলে নাকি এএসপি । শুনে রুপা বার দুয়েক ঢোক চেপেছিলো ।চোখ চোখ বড় বড় করে বলেছিলো -ওরে বাপরে ..পুলিশ !!
ছোট বেলা থেকেই কেন জানি পুলিশ দেখলেই রুপা ভয় পায় । ভয়ের কোন কারণই নাই , তবুও পায় ।সে চোর না , ডাকাত না , ছিনতাইকারী বা কোন প্রকারের অপরাধীও না তবুও ভয় যে কেন যায় না সেটা ভেবেই কূল পায় না বেচারি ।
মনে মনে রুপার কেন যেন রাগ হয়েছিল ভীষণ । বাপের ঠ্যালায়ই জান ওষ্ঠাগত তার ছেলে না জানি আবার কি ক্যাঁচাল লাগায় !
( চলবে...)