শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪

ডাক্তারের চোখের জল রোগীর না দেখাই ভালো...

মঙ্গলবার, মে ৪, ২০২১
ডাক্তারের চোখের জল রোগীর না দেখাই ভালো...

ডা. জামান অ্যালেক্স :

স্মৃতির পাতা

০৪-০৫-২০২১

🟥আমি ধরে নিয়েছিলাম আমি মারা যাচ্ছি। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৬ তে নেমে এলো। আমি একাকী হিমশীতল মৃত্যুর প্রস্তুতি নিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আমি আমার দুই কন্যার আনন্দিত মুখ কল্পনা করতে করতে মারা যাবো...

সৃষ্টিকর্তার প্ল্যানিং ভিন্ন ছিলো। আমি মারা গেলাম না। কিন্তু আমি মায়াময় বিভ্রমের জগতে প্রবেশ করলাম...

আমি সবসময় মনে করতাম আমি একা একজন মানুষ। কোভিড -১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবার পর আমি অস্বস্তিতে পড়লাম, আমার একাকী জগতে ঝামেলা দেখা দিলো, উলটপালট হয়ে গেলো। অসংখ্য মায়ায় আমি জড়িয়ে গেলাম...

স্বল্প সময়ের জন্য যারা আমাকে নিয়ে মায়ার জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ... 

অসংখ্য ঘটনা থেকে মোহময়ী কিছু ঘটনাগুলো আমার দেয়ালে লেখা থাকুক...

🟥 কিছুদিন আগে এক বিকেলে হঠাৎ করেই অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট। রাতের দিকে স্যাচুরেশন ৯১ এ নেমে এলো, পরদিন হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা ইমার্জেন্সী ডিউটি। ঝামেলায় পড়লাম, ইমিডিয়েটলি কারো সাথে ডিউটি এক্সচেঞ্জ করা গেলো না। অনেকটা বাধ্য হয়ে সরকারী হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা ডিউটি করতে গেলাম...

সারাদিন ভালোই কষ্ট গেলো, রাত ২ টায় শরীরটাকে আর টানতে পারলাম না, ঐ সময় স্যাচুরেশন ৮৯ দেখাচ্ছে, শ্বাসকষ্ট অনেক।  ভোররাত ৪ টায় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে  ভর্তি হলাম। ঢাকা মেডিকেলে আমার করোনা জীবন শুরু হলো। আমার জীবনটা জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি চলে গেলো...

হাসপাতালে এডমিট হবার পর থেকে একাধারে সেন্ট্রাল লাইন থেকে অক্সিজেন নেই। একটু পর পর পালস্ অক্সিমিটারের দিকে তাকাই। মন খুবই খারাপ থাকে...

জীবন মৃত্যুর এই দোলাচলে হঠাৎ লিজেন্ডারী অধ্যাপক ডা. আজিজুল কাহ্হার স্যার মেসেজ পাঠালেন যাতে অসুস্থতার যেকোন ইস্যুতে স্যারকে ফোন দেই...

আমি অবাক হয়ে অনেকক্ষণ চোখ পিটপিট করে স্যারের মেসেজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্যার কি সত্যিই মেসেজ দিয়েছেন?... 

স্যারের সাথে আমার সামনাসামনি শেষ দেখা ২০১৫ কি ২০১৬ তে, MRCP Exam দিতে গেলে একজন MRCP(UK) Holder এর আন্ডারে ট্রেনিং করেছি সেটা দেখাতে হয় এবং উনার মেইল আইডি নিয়ে UK তে পাঠাতে হয়, Log book টাও সাইন করিয়ে নিচ্ছিলাম। সেগুলো নিতে গিয়ে DMC তে স্যারের সাথে আমার শেষ দেখা। স্যারের পেছনেই স্যারের বুকশেলফ, সেখানে অনেক বইয়ের মাঝে Tim Hall এর বই দেখে পরদিন নিউমার্কেটের মল্লিক ব্রাদার্স থেকে Tim Hall এর বই কিনে এনেছিলাম...

However, আমার স্যারের মেসেজ পেয়ে আমার স্যাচুরেশন কি বেড়ে গেলো? আমার কেন যেনো মনে হলো আমি অনেকটা সুস্থ বোধ করছি...

স্যার ব্যস্ত থাকেন, ভাবলাম দেয়ালে একেবারে পিঠ ঠেকে গেলে স্যারকে ফোন দিবো। দুর্বল শরীর, অক্সিজেন লাগানো অবস্থায় ঘুমিয়ে গেলাম...

পরদিন ঘুম ভাঙলো স্যারের ফোনে, এই কণ্ঠ আমার চেনা, এই কণ্ঠের জন্য আমরা স্যারের ট্রেইনীরা সকাল থেকে DMC এর ওয়ার্ডে স্যারের ম্যাজিক্যাল, মিলিটারী, একাডেমিক  রাউন্ড এর জন্য অপেক্ষা করতাম...

স্যার জিজ্ঞেস করলেনঃ "জামান, কি অবস্থা?  তুমি কেমন আছো? "

কি বলেছিলাম মনে নেই, আবোল তাবোল কিছু বলেছিলাম হয়তো, চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো...

পরের কয়েকদিন স্যার নিজে থেকেই ফোন দিয়ে আমার ট্রিটমেন্ট গাইড করলেন...

মানুষ মানুষকে এতো মায়া কিভাবে করে? আমি একজীবনে কিভাবে আমার স্যারের এই ঋণ শোধ করবো?...

আহাম্মকের মতো কথা বললাম। স্যারদের ঋণ শোধ করা যায় না...

🟥১০ দিন পর হাসপাতাল থেকে বাসায় আসলাম। একটার পর একটা Post Covid জটিলতা দেখা দিলোঃ Myocarditis, Sicca syndrome, Extreme Fatigueness, Resistant night cough. শরীরে কি ভ্যারিয়েন্ট  ঢুকেছে আল্লাহই জানে! এতোটাই Weak থাকি যে ফোন ধরে রাখতে কষ্ট হয়। একা একা বিছানায় শুয়ে থাকি, মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট হয়...

এরই মাঝে এক আপা ফোন দিলেন। উনি একটি NGO এর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আমি ফোন ধরার পর উনি অনেকক্ষণ কাঁদলেন। আমার কষ্ট হচ্ছিলো ফোন ধরে রাখতে, কেউ কাঁদতে থাকলে কিভাবে বলি যে ফোনটা রাখি?

জিজ্ঞেস করলামঃ আপা কাঁদছেন কেনো?

উত্তর দিলেনঃ কয়েকদিন আগে আমার হাজব্যান্ড মারা গেলো করোনায়, আপনি সব রকম হেল্প করলেন, তাকে নিয়ে সিট পাবার জন্য এই হাসপাতাল, ঐ হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই উনি মারা গেলেন। কয়দিন আগে শুনলাম আপনি করোনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আমার হাজব্যান্ড মারা গেলো, দৌঁড়াদৌড়ি করতে গিয়ে তার জন্য নামায পড়ে দোয়াটাও করতে পারিনি। আপনি কি বিশ্বাস করবেন, আপনার কথা শোনার পর আমি আর আমার ছোট বোন নামায পড়ে আপনার জন্য দোয়া করেছি?...

আমি ভাবতাম আমি একাকী লোক, আমাকে নিয়ে কারো কোন Say বা চিন্তাধারা থাকার কথা না, কেউ অবশ্য চিন্তা করেও না। অথচ এটা আমি কি শুনলাম!!!

কি বিভ্রম! কি বিভ্রম!! কি বিভ্রম!!!

🟥প্রায় ২০ দিন হয়ে গেছে। দিনের বেলা ভলোই থাকি, খালি Tachycardia থাকে, ওষুধ খেতে আর ভালো লাগে না। বাসায় একাধারে থাকতেও ভালো লাগছে না। বাইরের আলো চোখে পড়ে না... 

ইমিডিয়েট ডিসিশন নিলাম বিকেলের দিকে চেম্বারে যাবো। আমি একা থাকতে পছন্দ করি সেটা ঠিক, কিন্তু ২০ দিন ধরে বাইরের জগৎ দেখি না, এই গরমে কৃষ্ণচুড়া গাছে লাল আগুনের মেলা বসে-সেটাও দেখতে পারছিনা, এটা কেমন কথা! এর কোন মানে হয়!!

হাসপাতালের রিসিপশনে ফোন দিয়ে জানালাম আমি বিকেলে রোগী দেখবো, যাবার পথে অনেক কৃষ্ণচুড়া গাছ পরে...

ধীরে ধীরে বাসা থেকে বের হয়ে লিফটে নেমে গাড়ীতে উঠলাম। হাসপাতালে নেমে আমার পরিচিত রুমে ঢুকলাম, চেয়ারে বসলাম। আমি কখনো ভাবি নাই যে আমি এই চেয়ারে আর কখনো বসতে পারবো। মানুষের জীবন কতই না অনিশ্চিত!!! Life is certainly uncertain... 

নিজের পালস্ নিজেই চেক করলাম, ১২০, বাসা থেকে বের হওয়া ঠিক হয় নাই। হাবিজাবি এসব রোগ নিয়ে চিন্তা করছি, এমন সময় দরজা খুলে পিয়ন জানালো রোগী এসেছে। রুমে ঢুকতে বললাম...

৬০ বছরের বৃদ্ধা, আমি তাকে চিনি, আমার কাছে প্রায়ই একা একা চিকিৎসার জন্য আসেন, শিক্ষিত, মাল্টিপল নন কম্যুনিকেবল ডিজিজ আছে। পুরোনো  ফাইল সহ রিসিপশনে যে টিকিট কেটেছেন সেটা আমার সামনে দিলেন...

আমি টুকটাক কথাবার্তা বলে বিপিটা চেক করে প্রেসক্রিপশন লিখলাম, এধরণের ক্ষেত্রে পেশেন্ট ভালো থাকলে আমি সাধারণত প্রেসক্রিপশন চেইঞ্জ করি না। আমি উনাকে বললাম, " মা'রে, আপনি তো আল্লাহর রহমতে ভালোই আছেন, আজকে না আসলেও চলতো, আপনার ফলোআপ ডেইট আরো পরে ছিলো..."

তিনি কি বললেন সেটা আপনাদের শোনাই। আসলে আপনাদের শোনানো থেকেও এটা লিখে রাখছি আমার দেয়ালে, যদি আজ থেকে অনেক অনেক বছর পর বেঁচে থাকি তবে ফেসবুক খুললে ঘটনাটা চোখে পড়বে, মনে হবে, 

'নাহ! আমার জীবনটা তো খুব একটা খারাপ ছিলো না...'

৬০ বছরের সেই বৃদ্ধা বললেনঃ

"স্যার, আমি শুনেছি আপনি অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি করোনা নিয়ে। আমি প্রতিদিন খবর নেই যে আপনি আসছেন কিনা। আমি আল্লাহকে বলছি, আমার তো কোন কাজ নাই, আমাকে নিয়া নাও, আমার ডাক্তারকে আল্লাহ তুমি বাঁচায় দাও..."

আমি মাথা নীচু করে বসে রইলাম। নতুন আরেকটা প্রেসক্রিপশনের সাদা পাতায় কলম দিয়ে অযথাই এবং অযথাই আঁকিবুঁকি করছি। ডাক্তারের চোখের জল রোগীর না দেখাই ভালো...

"Beauty is a terrible and awful thing! It is terrible because it has not been fathomed, for God sets us nothing but riddles. Here the boundaries meet and all contradictions exist side by side.” 

(Fyodor Doskoevski)

ডা.জামান..


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল