ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক:
ঈদুল ফিতর মানে সিয়াম সাধনা সমাপ্ত করার আনন্দ। আমরা সাধারণত মনে করি রমাদান মাসের শেষে যে ঈদ হয় শুধু সেটাই ঈদুল ফিতর। আসলে ঈদুল ফিতরের ধারণা আরও অনেক ব্যাপক। রাসূল (সা) এই আনন্দের জন্য একটি আরবী শব্দ ব্যবহার করেছেন। তা হলো ফারহাতুন। তিনি আরও বলেন এই ফারহাতুন বা আনন্দ দুটি।
প্রথম, রোজা সমাপ্ত করার বা রোজা ভঙ্গের আনন্দ। অর্থাৎ ফিতরের আনন্দ। এর আবার দুটি ধরণ আছে প্রত্যেক রোজার পর যে ফিতর বা ইফতার করা হয় তাতেও একটা আনন্দ রয়েছে। আর প্রধান আনন্দ হয় গোটা রমাদান মাস শেষে অর্থাৎ সব রোজা শেষে রমাদান মাসের পরের দিন যে আনন্দ করা হয়, যা ঈদুল ফিতর বলে পরিচিত।
সারকথা, সিয়াম সাধনা শেষ করার পর অর্থাৎ সব বাধ্যতামূলক রোজাগুলো সমাপ্ত করার পর রোজা ভঙ্গের যে আনন্দ সেটি হলো ঈদুল ফিতর। দ্বিতীয়, সিয়াম সাধনা সাফল্যের সাথে সমাপ্ত করার আসল আনন্দ হবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। এই ব্যাপারে রাসূল (সা) বলেন, যে রোজা বা সিয়াম ভঙ্গের একটি আনন্দ হলো আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করার সময় প্রথম আনন্দটি এই জন্য যে দীর্ঘ এক মাস ধরে আমরা সিয়াম সাধনা পালন করেছি। ক্ষুধা থাকলেও কিছু খাইনি, পিপাসার্ত অবস্থায়ও কিছু পান করেনি। সব ধরণের অন্যায় থেকে বিরত রয়েছি। এই সিয়াম সাধনা সাফল্যের সাথে শেষ করা একটা বড় আনন্দের ব্যাপার। এটা এক মহা আনন্দের ব্যাপার। এই জন্যই মুসলিম জাতির জন্য এই ঈদুল ফিতরকে একটি বড় আনন্দের দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রথম আনন্দ হলো অত্যন্ত সাময়িক জীবনের আনন্দ। যার শেষ আছে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার আনন্দের শেষ নেই, সীমা নেই। সিয়াম সাধনা সাফল্যের সাথে পালন করার পুরষ্কার হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে। সীমাহীন পুরষ্কার পাওয়া যাবে, আর আখিরাতে তাদের এই ঈদ উৎযাপনের জন্য একটা বিশেষ ব্যবস্থা করা রয়েছে। পৃথিবীতে বিশেষ কোনো উৎযাপন যেভাবে কোনো বড় হোটেল বা মিলনায়তনে হয়, সেভাবেই আখিরাতে রোজাদারদের ঈদ উৎযাপনের জন্য একটা বিশেষ বেহেস্তের ব্যবস্থা করা রয়েছে। সেই বেহেস্তের নাম হলো রাইয়ান। এই রাইয়ান নামক জান্নাতে উদযাপন করা হবে সিয়াম সাধনা সমাপ্ত করার আনন্দ।
কিন্তু কেন এতো আনন্দ?
আনন্দ এই জন্য যে গোটা একটি মাস ধরে আমরা অর্জন ও বর্জনের অনুশীলনী করি। আমরা যেন সব ধরণের নিষিদ্ধ ও অনাকাঙ্খিত জিনিস থেকে বেঁচে থাকতে পারি। সেগুলি বর্জন করে আমাদের মধ্যে মানবীয় গুণাবলি সৃষ্টি করতে পারি। সেই জন্য চলে বর্জনের মহড়া অনুশীলনী। যা হালাল তাও আমরা বর্জন করি, যেনো আমরা হারামের নিকটেও না যাই। সারা দিন ক্ষুধা আছে হালাল খাবার আছে কিন্তু খাওয়া যাবে না। পিপাসা আছে, হালাল এবং সুস্বাদু পানীয় আছে, কিন্তু পান করা যাবে না। আল্লাহতায়ালা মানুষের মধ্যে যৌনাকাঙ্খা দিয়েছেন, স্বামী আছে স্ত্রী আছে, তাদের সুসম্পর্ক হতে পারে কিন্তু সাওম বা রোজা এসে বলে না তা থেকে বিরত থাকো, তা বর্জন করো। এই ভাবে যা হালাল ও অনুমোদিত তাও বর্জন করি, যেনো আমাদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রনের যোগ্যতা অর্জিত হয়। অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারি। আত্মনিয়ন্ত্রনের এই অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা মানুষ এই জন্য যে আমাদের মধ্যে মানবীয় গুণাবলী আছে। অবাঞ্ছিত, অসামাজিক, অশালীন ও অশ্লীল গুণাবলী থাকা মানবীয় গুণাবলী মানুষের সাজে না। আমরা যদি আত্মনিয়ন্ত্রনের দীক্ষা গ্রহণ করতে না পারি তাহলে আমাদের মন যে দিকে যায় সেদিকেই আমরা যেতে চাই। অশ্লীল কাজে জড়িত হয়ে পড়ি। অসামাজিক কাজ থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হয় না। আমরা যদি অনুমোদিত হালাল থেকেও বেঁচে থাকা ট্রেনিং গ্রহণ করি তাহলে যা হারাম তা থেকে বেঁচে থাকা সহজ হবে। তখনই আমরা মানুষ হতে পারবো। কারণ আমরা মানুষ এই জন্য যে আমাদের মধ্যে মানবীয় গুণাবলী আছে। যদি মানবীয় গুণাবলী না থাকে তাহলে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। বরং পশুর চেয়েও খারাপ হয়ে যেতে পারে। একটা ক্ষুধার্ত গরুকে যদি ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সে অন্যের ক্ষেতে গিয়ে ফসল খেয়ে ফেলবে। কিন্তু তার পেট যখন ভরে যাবে তখন সে থেমে যাবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে যদি নৈতিকতার জ্ঞান না থাকে তাহলে তার ক্ষুধার শেষ থাকে না। সে যতো পায় ততো চায়। আরও চায় আরও চায়। যেখানে একটা গরু পেট ভরে গেলে থেমে যায়, সেখানে একটা মানুষ পেট ভরলেও থামে না। এই হিসেবে নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ আর মানুষ থাকে না এবং তারা জানোয়ারের চেয়েও অধম হয়ে যায়। এই জন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তারা হলো পশুর মতো, জানোয়ারের মতো, বরং তার চেয়েও অধম। রামাদান আমাদেরকে সংযম শিক্ষা দেয়, আত্মনিয়ন্ত্রনের শিক্ষা দেয়। আমাদেরকে পশু বৈশিষ্ট্য থেকে আত্মরক্ষার শিক্ষা দেয়। কাজেই যে সিয়াম সাধনা আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় এবং আমরা তার স্বার্থকবাদ অর্জন করতে পারি। সব ধরণের অন্যায় বর্জন করতে পারি। সেটা হবে মানুষ হওয়ার শিক্ষা, সেটা হবে সবচেয়ে বড় আনন্দ। আমরা পৃথিবীতে তার জন্য আনন্দ করবো। এবং যখন আখিরাতে যাবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হবে তখন পাওয়া যাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আমাদের সেই আনন্দ উৎযাপন করা হবে রাইয়ান নামক জান্নাতে।
সুতরাং সিয়াম সাধনা সাফল্যের সাথে শেষ করা, সমাপ্ত করা আনন্দ অর্থাৎ ঈদ একটি নয় বরং ঈদুল ফিতর হলো দুটি। ছোট ঈদুল ফিতর হলো দুনিয়াতে এবং সবচেয়ে বড় এবং অনন্তকালীন ঈদুল ফিতর হবে আখিরাতে। মজার ব্যাপার এই যে পৃথিবীতে আনন্দ উদযাপনের পর আমরা মিলনায়তন ত্যাগ করি এবং বাড়িতে চলে আসি। কিন্তু আখিরাতে রাইয়ান নামক জান্নাত মিলনায়তনে যে আনন্দ উদযাপন হবে সেখান থেকে রোজাদাররা আর বেরিয়ে আসবে না। তারা অনন্তকাল ধরে সে আনন্দ উদযাপন করতে থাকবে। আল্লাহ আমাদেরকে সেই অনন্তকালের ঈদুল ফিতর আনন্দের তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ