ধর্ম ডেস্ক:
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতে মুমিনের হৃদয়-মন শিহরিত হয়। ঈমান বেড়ে যায়। আল্লাহর অসীম ক্ষমতা জানার পর ভয়ে অন্তর কেঁপে ওঠে। কারণ এসময় মুমিনের চোখ-কান-হৃদয় সবকিছু কোরআনের মধ্যে ডুবে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী নাজিল করেছেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা বারবার পাঠ করা হয়। এতে তাদের দেহ-মন শিউরে ওঠে, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে। অতঃপর তাদের দেহমন প্রশান্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটি হলো আল্লাহর পথনির্দেশ। এর মাধ্যমে তিনি যাকে চান পথ প্রদর্শন করেন। আর যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন, তাকে পথ দেখানোর কেউ নেই।’ (সুরা জুমার: ২৩)
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের কাছে আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরসমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে।’ (সুরা আনফাল: ২)
অন্যদিকে কোরআন পড়েও কিছু মানুষ হেদায়াত লাভ করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা তাদের দাম্ভিকতা ও সন্দেহের কারণে হেদায়াত দেন না। কোরআন থেকে যারা হেদায়াত লাভ করতে পারে না, তাদের পরিচয় নিচে তুলে ধরা হলো।
১) অহংকারী-দাম্ভিক
অহংকারীরা কোরআন থেকে হেদায়াত লাভ করতে পারে না। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন কোনো সুরা নাজিল হয়, তখন তাদের মধ্যেকার কিছু (মুশরিক) লোক বলে, এই সুরা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান বৃদ্ধি করল? বস্তুত, যারা ঈমান এনেছে, এ সুরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দ লাভ করেছে।’ (সুরা তওবা: ১২৪)
এসব অহংকারীদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী পাপীর, যে আল্লাহর আয়াতের তেলাওয়াত শোনে, অথচ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে (কুফরের ওপর) অটল থাকে, যেন সে তা শোনেনি। তাকে সংবাদ দাও বেদনাদায়ক শাস্তির।’ (সুরা জাসিয়া: ৭-৮)
২) কোরআন নিয়ে সন্দেহপোষণকারী
সেসব মানুষ কোরআন থেকে উপকৃত হতে পারে না, যারা কোরআন সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছাড়া অহেতুক বাদানুবাদ করে, বাকপটুতা দেখানোর চেষ্টা করে এবং কোরআনের ওপর সন্দেহ-সংশয় পোষণ করে। এই বাদানুবাদ গুপ্ত অহংকারের সন্ধান দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা নিজেদের কাছে কোনো দলিল না থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর আয়াত নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাদের অন্তরে আছে শুধুই অহংকার। তারা এ ব্যাপারে সফল হবে না। সুতরাং আল্লাহর শরণাপন্ন হও, তিনি তো সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা মুমিন: ৫৬)
৩) পরকালে অবিশ্বাসী
যারা পরকালে অবিশ্বাসী, তারাও কোরআন থেকে উপকৃত হতে পারে না। কেননা কোরআনের উৎসাহ, উপদেশ ও সংশোধনের এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো পরকাল। কোরআন পরকাল সম্পর্কে সতর্ক করে, ভীতি প্রদর্শন করে এবং পরকালের সওয়াবের ব্যাপারে আশান্বিত করে। পরকালের সুদীর্ঘ সফরের জন্য পাথেয় জোগায়। এর জন্য যাবতীয় তথ্য ও নির্দেশনা দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা পরকালে বিশ্বাস করে, তারা কোরআনেও বিশ্বাস করে।’ (সুরা আনআম: ৯২)
বিষয়টি অন্য আয়াতে আরো স্পষ্টভাবে এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা (কেয়ামতের দিন) আমার সাক্ষাতের ভয় করে না এবং পার্থিব জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত থাকে, আর যারা আমার আয়াত সম্পর্কে উদাসীন, তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। এটা তাদের কৃতকর্মের জন্য।’ (সুরা ইউনুস: ৭-৮)
কোরআন যাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করে না
আর কিছু মানুষ অদূর ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করবে, যারা কোরআন পাঠ করবে ঠিকই, কিন্তু তেলাওয়াত তাদের স্বর ও কণ্ঠনালীও অতিক্রম করবে না। তাদের পরিচয় দিয়ে নবী (স.) বলেছেন— ‘পূর্ব এলাকা থেকে একদল লোক বের হবে। তারা কোরআন পড়বে, কিন্তু তাদের এ পাঠ তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়। তারা আর ফিরে আসবে না, যে পর্যন্ত তীর ধনুকের ছিলায় ফিরে না আসে। বলা হলো, তাদের চিহ্ন কী? তিনি বললেন, তাদের চিহ্ন হল মাথা মুণ্ডন।’ (সহিহ বুখারি: ৭৫৬২)
এ বিষয়ে অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, অচিরেই আমার উম্মতের মাঝে মতভেদ হবে। যাদের মাঝে একদলের ভাষা হবে মিষ্ট, কিন্তু কাজ হবে জঘন্য। তারা কোরআন পড়বে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে, যেমন ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়। আর ফিরে আসবে না, যে পর্যন্ত ধনুকের ছিলায় না আসে। যারা তাদের হত্যা করবে তাদের সাধুবাদ। তারা আল্লাহর কিতাবের দিকে আহবান করবে, কিন্তু আল্লাহর কিতাবের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। যারা তাদের হত্যা করবে তারা তাদের থেকে উত্তম হবে। সাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! তাদের নিদর্শন কী? তিনি বললেন, ন্যাড়া মাথা। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৬৭)
হজরত সুয়াইদ বিন গাফালা থেকে বর্ণিত, আলী (রা.) বলেন, ‘...আমি রাসুলুল্লাহ(স.)-কে বলতে শুনেছি, শেষ জামানায় এক জাতি আসবে। বয়সে হবে তরুণ। বুদ্ধিতে হবে কাঁচা। তারা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কথা বর্ণনা করবে। কিন্তু তারা দীন থেকে ইসলাম থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে, যেমন ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী ভেদ করে নিচে নামবে না। তোমরা তাদের যেখানে পাবে সেখানেই হত্যা করবে। কেননা যারা তাদের হত্যা করবে তারা কেয়ামতের দিন সওয়াব পাবে। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৬৯)
বস্তুত পরকাল ও অদৃশ্যে বিশ্বাসীরা অর্থাৎ মুমিন বান্দারাই কোরআন থেকে সর্বাধিক উপকৃত হয়। কোরআনের বিধানাবলীও এসেছে মুমিনদের জন্যই। ইরশাদ হয়েছে, ‘এই কোরআন পরহেজগারদের জন্য পথনির্দেশ, যারা অদৃশ্যের ওপর ঈমান আনে...’ (সুরা বাকারা: ২-৩)।
কোরআন থেকে হেদায়েত পাওয়ার শর্ত
মহাগ্রন্থ আল-কোরআন থেকে হেদায়াত পেতে হলে কয়েকটি মৌলিক গুণ থাকতে হবে। সেগুলো হলো-
১) তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়: যার হৃদয় আল্লাহর ভয়শূন্য, সে দ্বীন থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে উপদেশ দাও কোরআনের সাহায্যে।’ (সুরা ক্বাফ: ৪৫)
২) পরকাল ও অদৃশ্যে বিশ্বাসী: পরকাল ও অদৃশ্যে বিশ্বাসী মানুষ কোরআন থেকে সর্বাধিক উপকৃত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘এই কোরআন পরহেজগারদের জন্য পথনির্দেশ, যারা অদৃশ্যের ওপর ঈমান আনে..।’ (সুরা বাকারা: ২-৩)
৩) অনুসন্ধিত্সু আকুলতা: যার মধ্যে কোরআন শেখার প্রগাঢ় আগ্রহ নেই, সে কোরআন থেকে উপকৃত হতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) তাদের পথ দেখান, যারা তাঁর অভিমুখী।’ (সুরা রাদ: ১৩)
৪) মনোনিবেশ ও আনুগত্য: কোরআন থেকে উপকৃত হতে চাইলে অবশ্যই তার বক্তব্যের প্রতি যথাযথ মনোযোগ ও মনোনিবেশ থাকতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদের, যারা মনোযোগসহ কথা শোনে, অতঃপর যা উত্তম তার অনুসরণ করে। আল্লাহ তাদের সৎপথ প্রদর্শন করেন। আর তারাই বুদ্ধিমান।’ (সুরা জুমার: ১৭-১৮)
৫) কোরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা: কোরআন থেকে উপকৃত হতে চাইলে গভীর মনোযোগ দিয়ে কোরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। কোরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার বিষয়ে কোরআনে বহু জায়গায় তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ (সুরা মুহাম্মদ: ২৪)
৬) যথাযথ সম্মান প্রদর্শন: কোরআনের যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। কোরআন শুধুই তথ্যের বই নয়। আইন-কানুনেরও সংকলন নয়। কোরআন রাজাধিরাজ মহান আল্লাহর কালাম। তাই তার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। দেহ-মনকে পবিত্র রাখতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই এটি সম্মানিত কোরআন, যা আছে সুরক্ষিত কিতাবে। যারা পূতপবিত্র, তারা ছাড়া অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না।’ (সুরা ওয়াকেয়া: ৭৭-৭৯)
৭) আত্মনিয়োগ: কোরআন উপলব্ধি করার জন্য সংগ্রাম-সাধনায় আত্মনিয়োগ করা জরুরি। মানুষ যখন কোরআন সম্পর্কে অবগত হতে চায়, কোরআন থেকে উপকৃত হতে চায়, তখন আল্লাহর রহমত তার দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহ তাঁর কিতাব অনুধাবনের জন্য ওই ব্যক্তির বক্ষ উন্মুক্ত করে দেন। তাকে বুঝ দান করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্ম-পরায়ণদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত: ৬৯)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র কোরআনের নুরে নিজেদের আলোকিত করার তাওফিক দান করুন। কোরআন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা ও সমাজ গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমআই