মার্জিয়া লিপি:
অনন্ত যাত্রায় আমাদের সময়ের স্বপ্নদর্শী, কিংবদন্তি সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে একের পর এক খসে পড়ছে উজ্জ্বল নক্ষত্র। একে একে শুখাইছে ফুল এবে, নিভিছে দেউটি...। এবার চলে গেলেন প্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার।
৮ মে, ২০২৩, কলকাতার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছু দিন ধরেই। ৫ এপ্রিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিককে। এর পর শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশ নিয়ে একটি দীর্ঘ উপন্যাস লেখার খুব ইচ্ছে তাঁর, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে শুরু করে’ ৭১ সাল পর্যন্ত সময়কাল নিয়ে সেই উপন্যাস। তাঁর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যে অধরাই থেকে যায়- দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা। হয়তো সে উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পেত- বাস্তবের অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়ীতাদের।
১৯৪২ সালে উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্ম ‘উত্তরাধিকার', ‘কালপুরুষ', ‘কালবেলা', ‘গর্ভধারিণী’, ‘অগ্নিরথ’, ‘সাতকাহন’ -সহ অনেক কালজয়ী উপন্যাসের লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রাথমিক শিক্ষা জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে। ষাটের দশকে তিনি কলকাতায় আসেন। ভর্তি হয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলা বিভাগের (সাম্মানিক) স্নাতক স্তরে । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন।
কর্মজীবনে আনন্দবাজার প্রকাশনার সাথে যুক্ত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি ছিলো প্রচণ্ড আসক্তি । তাঁর প্রথম গল্প “অন্যমাত্রা” লেখা হয় মঞ্চনাটকের জন্যে। সেখান থেকেই তার লেখকজীবনের শুরু। গল্পটি ১৯৬৭ সালে ও প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয় দেশ পত্রিকায় ১৯৭৬ সালে। এছাড়াও ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী ও কিশোর উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর লেখা কিশোর গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুন বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চলচ্চিত্রে দেখা গিয়েছে অর্জুনকে। উপন্যাস ‘কালবেলা’ এবং ‘বুনো হাঁস’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র।
অনেক অসাধারণ লেখনীর শব্দের এই রূপকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ‘আনন্দ পুরস্কার‘, ‘আকাদেমী পুরস্কার, ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ এবং ‘আইয়াইএমএস পুরস্কার’ জয় করেছেন। স্ক্রীপ্ট লেখক হিসাবে জয় করেন ‘বিএফজেএ, দিশারী’ এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির এওয়ার্ড। সমরেশ মজুমদার বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা লেখক হিসাবে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন।
তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় - ছাপার অক্ষরে। স্কুলের গণ্ডি তখনও পেরোয়নি। স্কুলের লাইব্রেরির বই এর সম্ভারে রাখা ছিল - ‘উত্তরাধিকার’। বিখ্যাত ট্রিলোজি উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ এবং ‘কালপুরুষ’। ট্রিলোজি উপন্যাস সিরিজের মধ্যে দ্বিতীয় বই - ‘কালবেলা’। এ উপন্যাসের জন্য লেখক ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।পরবর্তীতে ত্রয়ী উপন্যাসে যুক্ত হয় আরেকটি পর্ব - ‘মৌষলকাল’ । কাহিনিগুলো মূলত অনিমেষ মিত্রের জীবন নিয়ে। মাধবীলতা আর অর্কও ছিল উপন্যাস জুড়ে।
শান্ত নিরিবিলি স্বর্গছেড়া চা বাগানের ওপাড়ে খঁটিমারির জঙ্গল, এপাড়ে আঙরাভাসা নদীর মাথার ওপরে ভুটানের পাহাড় থেকে আসা বিষন্ন মেঘের দল, মাঠ পেরিয়ে আসাম রোড, মদেসিয়া কুলিদের লাইন- এসব জুড়েই ছিল- ‘উত্তরাধিকার’ এ অনিমেষের আড়ালে থাকা সমরেশ মজুমদার স্বয়ং।
চা বাগানের নির্জন স্নিগ্ধ পরিবেশে জন্মানো সমরেশ মজুমদারের শৈশব-কৈশোরের নিজের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন এ উপন্যাসে। একজন অনিমেষের জীবনের বিভিন্ন পর্বে বিবর্তন- আত্ম - জিজ্ঞাসা আর আত্ম - অনুসন্ধানের কাহিনী বিধৃত হয়েছে বিশেষত উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ ও মৌষল কাল -এ।
এর আগে-পরে সমরেশ মজুমদার আরো বহু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর আখ্যানে ঘুরে-ফিরে এসেছে বিপ্লব ও সংগ্রাম। সমরেশ মজুমদারের লেখায় অরণ্য - না দেখেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম : জলপাইগুড়ি আর ডুয়ার্সের চা বাগান।
চা বাগানে বেড়ে ওঠেন সমরেশ মজুমদার । মফস্বল, এর মানুষজন, মফস্বলের প্রকৃতি, তার পাহাড়-নদী-জনপদ, জলপাইগুড়ির আশেপাশের তিস্তা-তোর্সা, সরাসরি উঠে আসে সমরেশের কলমে। ক্রমশ তাঁর কলম ছড়িয়ে পড়ে জলদাপাড়া, মাদারিহাট, বীরপাড়া, মালবাজার, রাজাভাতখাওয়া, হলং, গরুমারা, ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ পাহাড়-জঙ্গলে, চা-বাগানে।
সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের পটভুমি স্পর্শ করতে প্রথম দেশের সীমানা অতিক্রম করি। ২০০৩ সালের মে মাস। ২য় সপ্তাহের এক মধ্যবেলায় নেপাল সীমান্তবর্তী মিরিকের পাহাড়ী লেকে ঘুরে শিলিগুড়িতে পৌঁছাই। বাসস্ট্যান্ড থেকে জয়গাঁর বাসে মাদারীহাটের জলদা পাড়ায় যেতে সময় লাগে প্রায় চার ঘন্টা। অরণ্যের সামনে বাস যখন থামলো তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। দীর্ঘ পথ কুচবিহার, জলপাই গুড়ির ডুয়ার্সের চা বাগান পেরিয়ে এসেছি। দেখেছি বিখ্যাত নকশালবাড়ী, আঙরাভাসা নদী আর দুপাশের বিস্তীর্ণ চা বাগানের জীবনচিত্র।
পাঠকের মধ্যে তন্ময়তা সৃষ্টির অসামান্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। যদিও তিনি বলেছিলেন, এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশকের চাহিদার কারণেই তাঁর অনেক জনপ্রিয় উপন্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। লেখক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের ছিল গভীর যোগাযোগ। অসংখ্যবার তিনি এদেশে এসেছেন বিভিন্ন উপলক্ষ্যে। ২০১৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে প্রথম কথা হয় সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে। জানিয়েছিলাম- গর্ভধারিণীর জয়ীতা রোমান্টিসিজমে মুগ্ধ হলেও দীপাবলীর সংগ্রামকে বেশি পছন্দ আমার। আলোকচিত্রটি সেদিনে সম্মেলন শেষে আলাপচারিতার সময়ে ধারণ করা।
সর্বশেষ দেখা হয়, রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘরে। সেদিন মঞ্চে বসে বলছিলেন, তাঁর যাপিত জীবন ও লেখক হয়ে উঠার গল্প। ‘আমার জীবন আমার রচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতায় শুরুতে পাঠককে জানিয়েছিলেন, কলকাতার বিখ্যাত দেশ পত্রিকায় প্রথমবার পাঠানো তাঁর লেখা ছাপা হওয়ার গল্পটিও।
বেশ কয়েকবার যোগাযোগের পর সম্পাদক লেখাটা ছাপা হবে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আশ্বাস পেয়ে খুশিতে সাত বন্ধুকে কফি হাউসে খাইয়েছিলেন। কিন্তু পরের সংখ্যায় সেটি ছাপা হয়নি। ‘এরপর পাবলিক ফোন থেকে দেশ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক বিমল করকে কল করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করলাম।’ পরে কাগজে গল্পটা ছাপা হয়। ১৫ টাকা সম্মানী পেয়ে সেটাও বন্ধুদের খাওয়াতে হলো। সেই খাওয়ার লোভে বন্ধুরা তাঁকে আবারও লিখতে বলেন। সেই কফি খাওয়া ও খাওয়ানোর লোভ থেকেই সাহিত্যিক হিসেবে পদার্পণ করেন সমরেশ মজুমদার।
দীর্ঘ এই আড্ডায় বারবার উঠে আসে তাঁর উপন্যাসত্রয়ী উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষ প্রসঙ্গ। উপন্যাসত্রয়ী নিয়ে তিনি বললেন, এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি অনেকটা জোর করে লেখা। মন থেকে লেখেননি। বলা যেতে পারে, বাধ্য হয়েই লিখেছেন। উত্তরাধিকার প্রকাশের পর পাঠকদের আগ্রহের কথা ভেবে প্রকাশক সাগরময় ঘোষের নির্দেশে বাকি দুই পর্ব লেখা হয়।
উঠে আসে সাতকাহন এর দীপাবলির কথাও। বললেন, ‘আমার বাড়ির পাশে বারো বছরের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। তবে বিয়ের আট দিন পর বিধবা হয়ে মেয়েটি ফিরে আসে। এখান থেকে দীপাবলি চরিত্রটি তৈরি হয়।’
বাংলাদেশ নিয়ে একটি দীর্ঘ উপন্যাস লেখার খুব ইচ্ছে তাঁর, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে শুরু করে’ ৭১ সাল পর্যন্ত সময়কাল নিয়ে সেই উপন্যাস। তাঁর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যে অধরাই থেকে যায়- দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা। হয়তো সে উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পেত- বাস্তবের অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়ীতাদের।
মার্জিয়া লিপি , লেখক, গবেষক
সময় জার্নাল