তুহিন মালিক: টেস্ট ক্রিকেটে দিনব্যাপী বোলিং করেও যখন কোন বোলারই সফল হয়নি। দিনশেষে তখন মাত্র কয়েক ওভার বল করেই বিজয় নিশ্চিত করলো আরেক বোলার। একদিকে সবাই যখন শত শত বল ছুঁড়েও উইকেটের দেখা পায়নি। অন্যদিকে একজন তখন অল্পকিছু বল খরচ করেই সফল।
উদাহরণটা দিলাম, কোয়ালিটি ও কোয়ান্টিটির তফাৎটা বোঝানোর জন্য। অর্থাৎ কোন কর্মের কোয়ালিটি বা মান তার কোয়ান্টিটি বা পরিমানের চাইতে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
পয়েন্টটা কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে নয়। এটা উদাহরণ মাত্র। আসল পয়েন্টটা হচ্ছে, শবে ক্বদরের ইবাদত নিয়ে। অর্থ্যাৎ সারারাত জেগে দ্রুতগতিতে শত শত রাকাত মনোযোগবিহীন নামাজের চাইতে। ধীরে সুস্থে লম্বা রাকাতের। লম্বা রুকু-সেজদার। কোয়ালিটিসম্পন্ন অল্প নামাজই আল্লাহর সাথে অনেক বেশী কানেক্টেভিটি বা যোগাযোগ তৈরি করতে সক্ষম। আর ক্বদরের রাতে আল্লাহর সাথে এরকম কোয়ালিটি বা মান সম্পন্ন কানেক্টেভিটিই তৈরি করতে হবে। যেমনটা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘তুমি এমনভাবে নামাজ আদায় কর, যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ; যদি তুমি দেখতে অক্ষম হও, তাহলে মনে কর আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।’
প্রশ্ন হচ্ছে— আল্লাহর সাথে এই কানেক্টেভিটির পরিমাপটা মাপবো কিভাবে? হিসাবটা সোজা। সেজদায় গিয়ে যতটুকু চোখের পানি ফেলতে পারি। কানেক্টেভিটির পরিমাপটাও ততটুকু বাড়বে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘বান্দা আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হয়, যখন সিজদারত থাকে। অতএব তোমরা তখন অধিক দোয়া করতে থাকো।’
অনেকেরই জিজ্ঞাসা। ক্বদরের এই মহিমান্বিত রাতে কি কি ইবাদত করবো? এর সরল ও সহজ উত্তর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজেই দিয়েছেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘একদা আমি রাসুল (সাঃ)কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি ক্বদরের রাত সম্পর্কে অবহিত হতে পারি; তবে আমি কি করব? তখন রাসুল (সাঃ) আমাকে এই দোয়া পাঠ করার জন্য বললেন। দোয়াটি হলো: اَللَّهُمَّ اِنَّكَ عَفُوُّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُوْ عَنَّا ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি’। অর্থাৎ: ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।’
আসলে আল্লাহর পছন্দই হচ্ছে, তাঁর বান্দারা যেন ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। আর তিনি ক্ষমা করতেই থাকেন। করতেই থাকেন....। আর আল্লাহ তো ক্ষমা করতেই ভালোবাসেন। কিন্তু শয়তান মানুষকে সারাজীবন ধোঁকার মধ্যে রাখে। যাতে সে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে না পারে। আজকে কালকে করতে করতেই যেন মৃত্যু চলে আসে। অথচ আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন?’ ‘আল্লাহই তওবা কবুলকারী, করুণাময়।’ ‘যে খারাপ কাজ করে কিংবা নিজের প্রতি জুলুম করে, তারপর আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চায়, সে আল্লাহ্কে ক্ষমাশীল ও দয়ালু পাবে।’
তাই এ রাতে নিজের পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে বেশি বেশি তাওবা, এস্তেগফার, দোয়া, মোনাজাত করার পাশাপাশি। অবশ্যই আল্লাহর ফরজ বিধান এ রাতের মাগরিব, ইশা এবং ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করতে হবে। সাথে তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, কিয়ামুল লাইল, নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকারসহ নেক আমলে সময় কাটানো। কোরআনের অনেকগুলো পারা দ্রুতগতিতে তিলাওয়াত করার চাইতে। পরিমানে অল্প হলেও ধীরে সুস্থে শ্রুতিমধুর ভাবে। আয়াতের অর্থ বুঝে। শুদ্ধভাবে আদবের সাথে। পরিপূর্ণ তৃপ্তির সাথে আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করি।
এ রাতে দান, খয়রাত, সাদাকাহ, চ্যারেটি বা সৎকর্ম বেশী পরিমানে করি। কারন, দোয়া ও চ্যারেটির মাধ্যমে মানুষের তাকদিরের পরিবর্তন হয়ে থাকে।
হায়েজা মা-বোনরা এ মহিমান্বিত রজনীর সাওয়াব-সৌভাগ্য অর্জন থেকে বঞ্চিত থাকবেন না। তারাও বেশি বেশি দোয়া-ইস্তিগফার-তাওবা ও জিকির-আজকার করতে পারবেন এবং দান-সাদাকাহ, চ্যারেটি বা সৎকর্ম করতে পারবেন।
রমজানের শেষ দশকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কোমর বেঁধে ইবাদত করতেন। তিনি নিজে রাত জাগতেন এবং উনার পরিবারবর্গকে জাগিয়ে দিতেন। তাই অবশ্যই আমাদের পরিবারের সদস্যদেরকেও জাগিয়ে দিয়ে এ রাতের সৌভাগ্য লাভে উৎসাহিত করতে হবে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুল আমরা অনেকেই করে থাকি। তা হলো, অনেকেই মনে করি ক্বদরের রাত বুঝি শুরু হয় এশার পর থেকে। তাই মাগরিবের পর ইফতার শেষে দুনিয়াবি হাসি-তামাশা কিংবা পরচর্চার মত খোশগল্পে ব্যাস্ত থাকি। অথচ ক্বদরের রাত মাগরিবের পরই শুরু হয়ে যায়। চলে ফজর পর্যন্ত। টিভি বা মোবাইল স্ক্রিনের আসক্তি থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে রাখি। এগুলোর সঠিক ব্যবহারও করতে পারি। প্রয়োজনে বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারের লেকচার শুনি। মোবাইল স্ক্রিনে সূরা, তরজমা, তাফসির শিখি।
অর্থাৎ সারাংশ একটাই। অনুতপ্ত হয়ে, চোখের পানি ফেলে, গুনাহ মাফ চেয়ে। ভবিষ্যতের জন্য পুরোপুরি সংশোধিত হয়ে। নিজের ভিতরের ইগো বা অহংকারের এখনই দাফন করি। কাল থেকে অবশ্যই নিজের মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনি। মানুষের হক ফিরিয়ে দিয়ে ও মানুষের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে। আমৃত্যু আল্লাহর হুকুম ও রাসূল (সাঃ)এর প্রদর্শিত জীবন বিধান মত বাকি হায়াতের জীবনটুকু অতিবাহিত করতে পারাটাই হচ্ছে শবে ক্বদরের আসল প্রাপ্তি। সাথে অবশ্যই বোনাস হিসাবে পাচ্ছি, একনাগারে ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদতের চাইতেও অধিক পরিমানের সওয়াব।
আল্লাহ আমাকে সহ সবাইকে বুঝে আমল করার তওফিক দান করুন।