রাসেল আহামেদ :
---কিরে রঞ্জু আজকে একাই বসে আছিস? মন্টু ভাই আসে নাই?
---না। মন্টু ভাই এখনও আসে নাই। ক্লান্ত হলেই দখিনা হাওয়া খাওয়ার জন্যে আমার কাছে এসে বসে। যদিও আজকে দুপুর পেড়িয়ে ভাটি পড়ে যাচ্ছে তবে একবার হলেও আমার কাছে সে আসবেই। যাই হোক তুই কই যাবি?
---বাজারে আখতার ভাইয়ের কাছে যাব। তীব্র মাথা ব্যাথার কারনে গত দুইদিন পত্রিকা পড়া হয় নি। ভাবছি আজকের পত্রিকাটা পড়ের আসি।
---তাই ত বলি তোরে দেখি না কেন? ভাবছি হইত বোনের বাড়ি গেছিস। আমাকে পত্রিকা বাড়িতেই দিয়ে যায়। দেখ বইয়ের নিচে আছে হয়ত। এখানেই পড়ে ফেল।
----ও এটা ত মে মাস। শ্রমিক দিবস হয়ে গেলো। শ্রমিক দিবস ত বুঝলাম কিন্তু শ্রমিকের নায্য অধিকার ত এখনও প্রতিষ্ঠিত হলো না রে। এই দিন এলে গুরত্ব দিয়ে প্রতিবেদন করা করা হলেও সারা বছর আর শ্রমিকের খবর কেউ রাখে না। রঞ্জু তোর কি ধারনা শুনি?
----কিছু কথা আমার কাছেও চেপে আছে। আমি বলি তুই মিলিয়ে দেখ। এই যে আমাদের মহান শ্রমিক দিবস। মে দিবস নামেও খ্যাত। শ্রমিক দিবসে ইতিহাস আমি আর বলতে চাই না। তুই ভালো করেই জানিস। আমার কথা হলো শ্রমিকরা তাদের নায্য অধিকার পাওয়ার জন্যই ত আন্দোলন করেছিল। অনেক শ্রমিক মৃত্যু বরণ করেছিল। আবার আহত ও রক্তাক্তও হয়েছিল। তারা তাদের দাবি থেকে একচুলও পিছপা হন নি। বরং তারা তাদের নায্য অধিকার আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা অপরিসীম।
----আবার দেখ, আমাদের দেশে উন্নয়নের নামে শোষণ চলছে রে ভাই। একটা দেশ উন্নতি হবে কখন? যখন ঐ দেশের শ্রমিকের মজুরি যথাযথ দেওয়া হবে। অর্থ্যাৎ ঐ দেশের শ্রমিকের প্রতি অবিচার না করে তাদের পারিশ্রমিক সঠিক সময়ে দিবে ও মজুরির বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। আমাদের দেশে গার্মেন্টস ও কলকারখানার শ্রমিকদের কথায় ধর। কি পরিমিত পরিমাণে মজুরি দেওয়া হচ্ছে? বরং অনবরত তাদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। তাদের ইচ্ছামত খাটিয়ে বড় বড় শিল্পপতি ব্যবসা করছে। কিন্তু শ্রমিকের কথা তাদের মাথায় নেই। মাসিক বা দিনশেষে তাদের যে মজুরি সেটাও সঠিক সময়ে দিচ্ছে না। তাদের দিয়ে অধিক পরিমাণ কাজ করিয়ে স্বল্প বেতনভুক্ত করে রাখছে। অথচ তুই অন্যান্য দেশের দিকে তাকিয়ে দেখ ওদের সাথে আমাদের বিস্তর পার্থক্য। ওরা আমাদের দেশের শ্রমিকের তুলনায় ২০-৩০ গুন বেশি বেতন পায়। ওদের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ওরা এখন উন্নত দেশ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের দেশেও সম্ভবপর হতো যদি শ্রমিকের নায্য মজুরি দেওয়া হতো। মজুরি বাড়ানো হত। আমাদের দেশ গার্মেন্টস খাতের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে। তাহলে অন্য দেশের গার্মেন্টস শ্রমিক যদি ২০ গুন বেতন পায় তাহলে আমাদের এতো কম কেন? আবার গার্মেন্টস শ্রমিকদের অনেক দাবী থেকেই যাচ্ছে। দেশের উন্নতিকে ত্বরান্বিত করতে শ্রমিকের অবদান অপরিসীম। অথচ তাদের সাথে আমরা প্রতারণা করেই যাচ্ছি। তাদের অবহেলার পাশাপাশি মতামতকে গুরুত্বহীন মনে করছি। এটা কি তাদের সাথে অবিচার নয়? এর সঠিক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আমাদের দেশের শ্রমিকরা বেশি সময় ধরে কাজ করলেও পোষানো বেতন বা মজুরি পায় না।যার ফলে দেশে উন্নতির নামে একধরনের শোষণও হচ্ছে বটে।
কিন্তু বর্তমান শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে তোর সাথে একটু আলোচনা করি। তুই বল শ্রমিক দিবস ঠিকই পালিত হচ্ছে বা বিশ্ববাসী এই দিবসের মর্যাদাও সমুন্নত রেখছে কিন্তু শ্রমিকদের কি আদোও এখনও কাংখিত মজুরি বা তাদের সম্মান দেওয়া হয়? তুই খেয়াল করে দেখ সেদিন চট্টগ্রামে কি ঘটানা ঘটে গেল?পুলিশ গুলি করে বাশখালিতে ৪/৫ জনকে মেরেই ফেলল।তাদের দাবি আদায় কি তারা করে নিতে পারল?বরং তারা হেনস্তা হলো।পরিবার তাদের আয়-রোজগারের একজন আদর্শিক ব্যক্তি হারালো।যে কিনা একাই পরিবারের অবকাঠামো ও নিয়ন্ত্রণে সর্বদা অটল ছিল।কিন্তু তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো।এই ভাবে যদি শ্রমিকরা গুলি খেয়ে মরেই যায় তাহলে কিসের মে দিবস?কিসের শ্রমিক দিবস?এ সব দিবস একদিন পালন করেই মানুষ অনেক নামি-দামি কাজ করে ফেলল।অথচ আজও ত শ্রমিক নির্যাতিত।কই কেউ ত প্রতিবাদ করল না?জোড়ালো ভাবে এর তীব্র প্রতিবাদ পত্রিকায় হলো না?দুই একজন যাও করেছে তাদের অগ্রাহ্য করা হয়েছে।আইনি ভাবেও অনেক দাবি জানানো হয়েছে।কিন্তু তা কতটুকু হাসিল হবে তা বলা যাচ্ছে না।কারন অনেক কিছুই ত আদালতে দায়ের করা হয়।কয়টার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনা হয় তা নিয়ে সবার মাঝেই কিছু না কিছু সন্দিহান থেকেই যায়।
-----ঠিকই বলেছিস রঞ্জু।এখনও শ্রমিকদের অবহেলার চোখে দেখা হয়।তাদের ঘাম ঝরানো উপার্জিত অর্থ তারা সরকারি খাতে ট্যাক্স হিসেবে দিচ্ছে।সেই অর্থ আমাদের লেখাপড়ায় খরচ হচ্ছে।বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে।আমার দেশের কৃষক-শ্রমিক ক্ষেত-খামারে শ্রম দিয়ে চাষাবাদ করছে।তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই আমরা আজ বড় বড় আসনে বসে ক্ষমতার বাহাদুরি করছি।অথচ আমরা লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মানুষ বিবেকহীনতার পরিচয় অনবরত দিয়েই যাচ্ছি।একটি বারের জন্যও খেটে খাওয়া মানুষ গুলোর জন্য ভাবি না।তাদের পাশে দাড়ানো ত দুরের কথা তাদের খোজ-খবর রাখিই না।বরং আমার দেশের তথাকথিত শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা তাদের সম্মান দিয়ে কথা না বলে তুই তুকারি করে।
আমাদের সমাজে কুলি,মজুর,কৃষক,শ্রমিক,রিকশা চালক,ভ্যান চালক,ড্রাইভার নানা রকম পেশার মানুষ গুলো বড়ই অবহেলার পাত্র।
----রুনেল,তোকে আরেকটা কথা স্মরণ করিয়ে দেই কিছুদিন আগে লকডাউনের সময় অনেক রিকশা চালক পেটের দায়ে রাস্তায় নেমে পড়ছিল।তাদের দাবি আমাদের ঘরে চাল,ডাল,আহার করার মত তেমন কিছুই নেই।আরো ঘরে অসুস্থ বাবা-মা,স্ত্রী বা অন্যান্য পরিজন।এমতাবস্থায় আমাদের আইন অমান্য করা ছাড়া উপায় নেই।সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা তাও জানি না।যদি নিয়েও থাকে আমরা তা পাই নি।যাদের মাধ্যমে আসে তাদের পেটেই সব চলে যায়।আমাদের পর্যন্ত কোনো কিছুই আসে না।এখন আমরা কি করব?এমন দাবিও উঠে এসেছিল।কিন্তু এসব দাবিকে দাবিয়ে দিতে পুলিশ কি করল?পুলিশ লাঠি চার্জ করল।শুধু এতেই খ্যান্ত হয় নি পুলিশ তাদের রিকশা গুলোকে রাস্থায় উল্টিয়ে ফেলে দিল।তাদের বিভিন্ন মামলা দিয়ে দিল।তাদের উপর মারধর করল।কিছু কিছু মানুষ এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।তবুও যেন এসব থেমে থাকে না।তাদের উপর কেমন যেন অসমতা করা হয়।দেশে কেন জানি বৈষম্যের উপদ্রব বেড়েই চলছে।অথচ দেখ এদিকে শ্রমিক রিকশাচালক মার খাচ্ছে আরেকদিকে প্রাইভেট কার নিয়ে,মোটরসাইকেল নিয়ে অনেক বড় বড় পদে থাকা বা ক্ষমতাসীনরা হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে পুলিশ ভাইয়ের কিঞ্চিৎ ভ্রুক্ষেপ নেই।তাদের বিরুদ্ধে মামলা মকদ্দমা নেই।বরং ক্ষমতাসীন লোকদের মামা,খালা,ফুফু,ফুফা,নানা,দাদা,বাবা কে এমপি,কে মন্ত্রী,কে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতি অথবা আত্মীয় সেই বড়াই করেই পার পেয়ে যায়।তাদের এক ফোন কলেই যেন সাত খুন মাফ।কেন ভাই কেমন ব্যাপার এটা?নাগরিক হিসেবে সবারই ত সমান অধিকার পাওয়ার কথা।সবার জন্যই ত আইন সমান।তাহলে রিকশাচালক,শ্রমিকদের বুকে কেন গুলি,কেন লাঠি চার্জ আর অর্থবিত্তদের,ক্ষমতাসীনদের সাথে সৎ ব্যাবহার?এগুলো কি শ্রমিক দের প্রতি অবিচার নয়?সহজ-সরল মানুষদের প্রতি অবহেলা নয়?তাদের নায্য অধিকারের প্রতি অমর্যাদা নয়?
এসব ভাবলে দেহের লোম শিহরিত হয়ে উঠে।আমরাই ত তাহলে মিথ্যাচারে লিপ্ত আছি।কেন আমরা মে দিবস,শ্রমিক দিবস নিয়ে প্রতিপাদ্য করছি?কখনও তাদের অধিকারের কথা বলি না?শুধু শুধু ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করি।মিথ্যা আশা দিয়ে তাদের সাথে প্রতারণা করছি।আজও শ্রমিকের মজুরি আমরা সঠিকভাবে দেই না।তাদের সাথে ভালো আচরণ করি না।তাদের যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা করি না।এসব কি আমাদের ভুল নয়?আমরা কি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারি না?আমাদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করে খেটে খাওয়া মানুষের কথা ভাবতে পারি না?অন্তত পক্ষে তাদের সম্মান দিয়ে,ভালোবাসা দিয়ে তাদের পরিশ্রমের ঋন পরিশোধ করার চেষ্টা ত করতে পারি।তাদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে আমরাও বলতে পারি---
----------------------
এসো হে ভাই,কৃষক-শ্রমিক
আদায় করো পারিশ্রমিক
দেশ উন্নয়নে তোমরাও সঙ্গী
এটাই হোক তোমাদের দাবী।
---✍️✍️✍️
রাসেল আহামেদ,গনিত বিভাগ
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।