আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
দীর্ঘ দুই দশক ধরে তুরস্কের ক্ষমতায় রয়েছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। জীবনে প্রায় এক ডজন বড় বড় নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন তিনি। তবে আগের সব নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচন ছিল তার জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার দল একে পার্টির জোট বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে। বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অল্পের জন্য জিততে পারেননি তিনি। এর ফলে দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা অনুষ্ঠিত হবে এটি অনেকটাই নিশ্চিত।
প্রথম দফা নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জনমত জরিপে এরদোয়ানের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন বিরোধী প্রার্থী কেমাল কিলিচদারুগ্লু। বলা হচ্ছিল প্রথম দফাতেই তিনি জয়ী হতে পারেন। তবে নির্বাচনী ফলে ঘটেছে জরিপের উল্টো। অল্পের জন্য জয়ের বৈতরণী পার করতে পারেননি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। অপরদিকে এরদোয়ানের চেয়ে প্রায় ৪ শতাংশ ভোটে পিছিয়ে রয়েছেন কিলিচদারুগ্লু। যদিও এই ব্যবধান সামান্য।
তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিততে হলে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হয়। তবে এই মাইলফলক কোনো প্রার্থী পার করতে পারেননি। ৪৯ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পেয়ে সবার আগে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। এছাড়া ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন কিলিচদারুগ্লু। তৃতীয় প্রার্থী ওগান পেয়েছেন ৫.২৮ ভোট।
স্পেক্টেটর ইন্ডেক্স এক টুইটবার্তায় বলেছে যে, একদিন আগে বিভিন্ন জরিপে বলছিল যে এরদোয়ানের জেতার সুযোগ রয়েছে ৩৪ শতাংশ। তবে দিন শেষে সেটি ৬৬ শতাংশে পৌঁছে যায়।
রুদ্ধশ্বাস ফলাফল
এরদোয়ান এগিয়ে থাকলেও ফলাফল এতটাই কাছাকাছি যে, যেকোনও কিছুই ঘটার সুযোগ ছিল। ফল ঘোষণা হওয়া শুরু করলে দেখা যায় অনেকটাই এগিয়ে আছেন এরদোয়ান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি সংশয়ে রূপ নেয়। কিলিচদারুগ্লু শেষ পর্যন্ত প্রায় ছুঁয়ে ফেলছিলেন এরদোয়ানকে। তবে শেষ পর্যন্ত চমক ধরে রেখেছেন এরদোয়ান।
দ্বিতীয় দফার ভোট কবে?
আগামী ২৮ মে দ্বিতীয় দফায় ভোট হবে তুরস্কে। সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও কেমাল কিলিচদারুগ্লুর মধ্যে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দুই জন প্রার্থী থাকায় এই ভোটেই ৫০ শতাংশের মাইলফলকে উত্তীর্ণ হবেন যেকোনও একজন। তিনিই হবেন তুরস্কের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।
বাস্তবতা হলো প্রথম রাউন্ডে ছিল কিলিচদারুগ্লুর জয়ের সেরা সুযোগ। মোমেন্টাম এখন ব্যাপকভাবে এরদোয়ানের দিকে ফিরে এসেছে।
দ্বিতীয় দফা ভোটে এরদোয়ানের চ্যালেঞ্জ ও সুবিধা
প্রথম দফা ভোটের আগে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জয়ের জন্য যেসব বিষয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছিল, দ্বিতীয় দফায়ও অনেকটা তাই বহাল থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি। এছাড়া সাম্প্রতিক ভূমিকম্প তো রেছে। এর চেয়েও বড় যে চ্যালেঞ্জ হলো তরুণ ও নতুন ভোটার। বেশিরভাগ আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত এসব তরুণরা এরদোয়ানকে আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান না। এই বিষয়টি বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। তবে প্রথম দফার ভোটে সেই প্রভাব অনেকটাই কম বলে মনে করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনে এরদোয়ানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হিসেবে দেখা দিতে পারে পার্লামেন্টের একে পার্টি ও তার জোটের বড় জয়। ৬০০ আসনের মধ্যে ৩২১ আসন জিতে নিয়েছে পিপলস অ্যালায়েন্স জোট। যেহেতু এরদোয়ানের দলের জোট পার্লামেন্টে সংখ্যাধিক্য তাই সাধারণ ভোটাররা সাংঘর্ষিক বা বিরোধী প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট বানাতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। পিপলস অ্যালায়েন্সের বিরোধী জোট থেকে প্রেসিডেন্ট হলে যেকোনো আইন পাস করতে হলে অনেক বেগ পেতে হবে। যা ভবিষ্যতে দেশটিতে বিভিন্ন আইন প্রনয়ণ ও সুক্ষ্মভাবে পরিচালনার পথে বাধা হতে পারে।
কিলিচদারুগ্লু কতটা পারবেন?
পূর্বে নির্বাচনে হারলেও কেমাল কিলিচদারুগ্লুর এবারের বিষয়টি ভিন্ন। তার সঙ্গে রয়েছে প্রধান বিরোধী ছয়টি দল। তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি অনেক তুর্কির মনের কথা। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে এরদোয়ান ক্ষমতায় থাকায় অনেক তুর্কি পরিবর্তন চান। তরুণ ভোটাররাও ধর্মীয় গাম্ভীর্যতা থেকে বেরিয়ে আধুনিক তুরস্কের পক্ষে। এসব কারণই প্রথম দফায় কিলিচদারুগ্লুর ভোট বহুঅংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় দফায়ও তিনি এসব বাজি ধরতে চাইবেন এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। তবে তার বড় অসুবিধার জায়গা হলো তার দলের জোট নেসন্স অ্যালায়েন্স পার্লামেন্টে জয়ী হতে পারেনি। পিপলস অ্যালায়েন্স থেকে অনেকটাই পিছিয়ে তারা। এর ফলে সংসদে তাদের শক্তিও অনেক কম। সাধারণ ভোটাররা হয়তো এই বিষয়টি মাথায় রাখবেন।
রানঅফ তথা দ্বিতীয় রাউন্ডে কিলিচদারুগ্লু জিতেও যান তাহলে তিনি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটি পূরণ করতে পারবেন না।
আল জাজিরার জেইনা খোদর বলেছেন যে, যদি রানঅফ তথা দ্বিতীয় রাউন্ডে কিলিচদারুগ্লু জিতেও যান তাহলে তিনি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটি পূরণ করতে পারবেন না। কারণ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ তার বিরোধী পিপলস অ্যালায়েন্স জোট। এজন্য এই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে জনগণের সন্দেহ জাগবে।
খোদর বলেন, বিরোধী দলের কিছু সদস্য আছেন যারা কিলিচদারুগ্লুকে নিয়ে হতাশ এবং তাকে ভুল প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ তিনি দল থেকে রক্ষণশীল ভোটগুলোকে দূরে সরিয়ে নিতে পারেননি। এছাড়া তারা কুর্দিপন্থী এইচডিপির সাথে জোট নিয়েও প্রশ্ন তুলছে, যাকে তুর্কি সরকার পিকেকে এর রাজনৈতিক শাখা বলে মনে করে।
প্রস্তুত দুই প্রার্থীই
প্রথম দফা নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় দুই প্রার্থীই দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোটের জন্য প্রস্তুত। এ বিষয়ে এরদোয়ান বলেন, ‘দেশের মানুষের ইচ্ছায় দ্বিতীয় দফায় লড়তে প্রস্তুত রয়েছি আমি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় জাতীয় ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়েছি। এই নির্বাচন ও আগামী নির্বাচনেও আমরা জাতীয় ইচ্ছাকেই সম্মান জানাব।’
তবে দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোটে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী কিলিচদারুগ্লু। তিনি বলেছেন যে, রানঅফ ভোট তিনি মেনে নেবেন এবং জিতবেন। তার দাবি, সমস্ত মিথ্যা এবং আক্রমণ সত্ত্বেও, এরদোগান কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাননি।
প্রভাব ফেলবেন তৃতীয় প্রার্থী সিনান ওগান
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে কম আলোচিত হচ্ছেন তৃতীয় প্রার্থী সিনান ওগান। তবে রানঅফ ভোটে তিনি মোটেও অবহেলিত থাকবেন না। প্রথম দফায় ৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন ওগান। দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি যাকে সমর্থন দেবেন, আশা করা হচ্ছে এই ভোটের বেশিরভাগই তার পক্ষে যাবে।
সিনান ওগান বলেছেন যে, এইচডিপিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বাদ দেওয়া হলে বিরোধী নেশনস অ্যালায়েন্সকে সমর্থন দেবেন তিনি।
প্রথম দফায় এরদোয়ানের চেয়ে মাত্র চার শতাংশ ভোটে পিছিয়ে আছেন কিলিচদারুগ্লু। তিনি যদি সিনান ওগানের ভোটগুলো পরবর্তী রাউন্ডে পান তাহলে তার জন্য নির্বাচনী ফলে ব্যাপক সহায়ক হবে। এরদোয়ানের জন্য জয় তখন আরও কঠিন হয়ে যাবে। এমনকি প্রথম দফার চেয়েও দ্বিতীয় দফায় আরও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা যেতে পারে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাকান আকবাস রয়টার্সকে বলেছেন, 'পরবর্তী দুই সপ্তাহ তুরস্কের ইতিহাসে সম্ভবত দীর্ঘতম দুই সপ্তাহ হবে এবং অনেক কিছু ঘটবে। আমি ইস্তাম্বুল স্টক এক্সচেঞ্জে একটি উল্লেখযোগ্য ক্র্যাশ এবং মুদ্রার প্রচুর ওঠানামার আশা করব। উভয় পক্ষই নিজেদের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে এরদোয়ান সুবিধায় থাকবেন। তবুও, আগামী দুই সপ্তাহে অনেক কিছু ঘটতে পারে।'
অর্থনীতিবিদ টিম অ্যাশ রয়টার্সকে বলেন, ‘বাস্তবতা হলো প্রথম রাউন্ডে ছিল কিলিচদারুগ্লুর জয়ের সেরা সুযোগ। মোমেন্টাম এখন ব্যাপকভাবে এরদোয়ানের দিকে ফিরে এসেছে। আত্ম-সন্দেহ বিরোধীদের মধ্যে ফিল্টার হয়ে যাবে যে, কেমাল কিলিচদারুগ্লু কি সেরা প্রার্থী ছিলেন?’
চাথাম হাউসের সহযোগী ফেলো গালিপ দালে বলেন, ‘যদি বর্তমান সংখ্যা সুপ্রিম ইলেকশন বোর্ড দ্বারা নিশ্চিত করা হয়, তাহলে গভর্নিং কোয়ালিশন সংখ্যার দিক থেকে ও মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে। পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এবং এরদোয়ান কিলিচদারুগ্লুকে পেছনে ফেলতে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে প্রস্তুত।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে প্রচারাভিযানের সময়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সম্ভবত স্থিতিশীলতার উপর জোর দেবেন। কারণ তিনি ইতোমধ্যেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রেখেছেন এবং বিরোধীদের 'সন্ত্রাসীদের' সঙ্গে কাজ করার অভিযোগ করেছেন।’
এমআই