শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

স্মৃতির এলবামে ঈদ

সোমবার, মে ১০, ২০২১
স্মৃতির এলবামে ঈদ

ডা. আফতাব হোসেন :

আসছে ঈদ। ঈদ মানেই তো আনন্দ। অথচ আমার মনে আনন্দের ছিটে ফোঁটাও নেই। কী করে থাকবে? কাল নাগিনী করোনা আমাদের সকল আনন্দ, সকল উচ্ছ্বাস কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে আমাদের চলাচলের স্বাধীনতা। যে যার ঘরে, যে যার দেশে বন্দি হয়ে পড়ে আছি। আমি বাংলাদেশে। একমাত্র ছেলে ইংল্যান্ডে। যার নাড়ী ছিঁড়ে এই পৃথিবীর আলো দেখেছি, সেই মা আমার সাত সমুদ্র, তের নদীর ওপারে, এই গোলার্ধের অন্য পাশে আমেরিকায়। চাইলেও কেউ কারও কাছে আসার উপায় নাই। অথচ একটা সময় ছিল, মা, বাবা, ভাই বোন মিলে সবাই একসাথে থাকতাম। প্লাটিনাম শ্রমিক কলোনিরে এক কামরার বাসায়। বিত্ত বৈভব না থাকলেও সুখের অভাব ছিল না। আজ সব আছে, শুধু সুখটাই হারিয়ে গেছে !

মনে পড়ে, ছেলেবেলায় রোজার শুরু থেকেই আমাদের দিন গোনা শুরু হয়ে যেত। আসছে খুশির ঈদ। শেষ দশ দিন তো আর সময়ই কাটতে চাইত না। কবে উঠবে আকাশে এক ফালি ঈদের চাঁদ ? সেই চাঁদ দেখার জন্য ছেলেবেলায় কি চেষ্টাটাই না করতাম। বাড়ির ছাদে, গাছের ডালে, পানির ট্যাংকির উপরে, কোথায় না চড়েছি। যেদিন পশ্চিমাকাশে মেঘ করত, সেই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকত চিকন নথের মত চাঁদ। ঈদের চাঁদ না দেখতে পারার কষ্টে খুব মন খারাপ হত আমার। সন্ধ্যের পর গোল হয়ে বসতাম আমাদের লাল ট্রানজিস্টারটি ঘিরে। কান খাড়া করে থাকতাম, কখন বলে, “একটি বিশেষ ঘোষণা, ঈদের চাঁদ দেখা গিয়েছে। কাল যথাযোগ্য মর্যাদায় সারা দেশে পবিত্র ঈদুল ফিতর পালিত হবে। ঈদ মুবারক”। খুশিতে হৈহৈ করে উঠতাম। আসলে চাঁদ দেখার পর থেকেই শুরু হয়ে যেত আমাদের ঈদ। 

প্লাটিনাম শ্রমিক কলোনিতে ছিল হাজার পাঁচেক মানুষের বিশাল এক পরিবার। আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা জড়ো হতাম কলোনির মাঠে। মার কাছ থেকে অনুনয় বিনয় করে পয়সা নিয়ে কিনতাম পটকা কিংবা তারা বাজি। সে রাতে উত্তেজনায় কিছুতেই ঘুম আসত না আমার। কখন সকাল হবে, কখন নতুন জামা পড়ব। আজ ভাবলে অবাক লাগে, নতুন জামা কিনে লুকিয়ে রাখতাম, যাতে কেউ দেখে না ফেলে, তাহলে যে এর নতুনত্ব চলে যাবে! অথচ একটা মাত্র ছেলে আমার, বলে কয়েও ঈদে নতুন কাপড় কেনাতে পারিনা। ব্রিটিশ কেতায় বড় হওয়া ছেলে, কাপড় থাকতে নতুন কাপড় কেন কিনতে হবে, বুঝতে পারেনা। ওর হয়ে আমিই কিনি। ও না পড়লেও আমিই পড়ি। ও কেমন করে জানবে? ওর বয়সে, বছরে একমাত্র ঈদের সময়ই নতুন কাপড় জুটত আমাদের! সেই জন্যই বোধহয় নতুন কাপড়ের প্রতি আমার এত আকর্ষণ। যে কোনো বাহানায় নতুন কাপড় কিনি। আজ ছেলেটা কাছে নেই। জীবনে বোধহয় এই প্রথম ঈদ, আমি কোনো নতুন কাপড় কিনিনি। 

মনে পড়ে ঈদের দিন কলোনির মাঠে নামাজ পড়তে যেতাম। সে কী বিশাল আয়োজন। হত হাজার মানুষের সমাগম। মিলের চট এনে ঢেকে ফেলা হত পুরো মাঠ। সবার পরনে সাধ্যমত নতুন পাজামা পাঞ্জাবী। মাথায় টুপি। মেসক আম্বর আতরের গন্ধে মৌ মৌ চারিদিক। নামাজ শেষে, ছোট বড়, ধনী গরীব নির্বিশেষে কোলাকুলি। যেন শেষই হতে চায় না ভালবাসার সে আলিঙ্গন, যেন প্রাণের সাথে প্রাণ মেলাবার সে এক অনুপম বিনোদন। তারপর শুরু হত দল বেঁধে বাসায় বাসায় যাওয়া। রক্তের সম্পর্ক নয়, তবু যেন আত্মার আত্মীয় সবাই। কত আদর করে খেতে দিতেন কত কী। খুব বেশী খেতাম না। অনেক বাসায় যেতে হবে যে! যতটা না খাওয়ার লোভে যেতাম, তার চেয়েও বেশী যেতাম এক টাকা দু’ টাকা ঈদী পাওয়ার আকর্ষণে। ধনে গরীব কিন্তু মনে আমীর সেই মানুষগুলোর এক দুই টাকার ঈদী আমার কাছে ছিল সাত রাজার ধনের মত। দিনের শেষে বেশ ভালই ফুলে ফেঁপে উঠত আমার রাজ ভাণ্ডার। সন্ধ্যায় সেই টাকা দিয়ে দেখতাম সিনেমা। ইভিনিং শো, ছ’টা ন’টা। কখনো কখনো পর পর দুটা, ইভিনিং শো থেকে বেরিয়ে নাইট শো, ন’টা বারোটা। ঈদের দিন ছিল মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়াবার দিন। সঙ্গী হত আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, আমার ছায়া-সঙ্গী, শাহজাদা সেলিম, আমার সুখ দুঃখের সাথী ফারুক, আমারচে এক বছরের ছোট অথচ লম্বায় এক হাত বড় সাঈদ। কখনও কখনও জুটে যেত লাল টুকটুক মেয়েলী চেহারার জামাই রফিক। 

যত বাসায়ই খাই না কেন, মায়ের হাতের রান্না না খেলে পেট ভরত না। বন্ধুদের নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যেত। অবাক হয়ে দেখতাম, আব্বা তখনও না খেয়ে আমাদের পথ চেয়ে বসে আছেন। আমাদের সাথে নিয়ে তবেই খেতেন। কোনো পার্বণেই এর ব্যতিক্রম হত না।

আরও একজন ঈদের দিন খাবার নিয়ে অপেক্ষা করত। রাণী। পরীর মত মেয়ে। সোনার বরণ গায়ের রঙ। সেই জন্যই বুঝি বাবা তার মেয়ের নাম রেখেছিলেন রাণী। মেয়ের চাঁদমুখ দেখে হয়ত স্বপ্ন দেখতেন, একদিন মেয়ে তার কোনো রাজমহলের রাণী হবে। পড়ত আমাদের ক্লাসেই। থাকত প্লাটিনাম অফিসার্স কলোনিতে। শ্রমিক কলোনি থেকে আমি যখন সেই অফিসার্স কলোনিতে যেতাম, ছবির মত সাজানো গোছানো কোয়ার্টার, নানা রকম বাহারি ফুলের বাগান, সে সব ফুলের মৌ মৌ মাতাল করা গন্ধে মনে হত আকাশের কাছাকাছি কোনো স্বর্গে চলে এসেছি। কোনো এক অবোধ্য কারণে মেয়েটি আমাকে ভালোবাসত খুব। না, কোনো প্রেমের ভালোবাসা নয়। ব্যাখ্যা-হীন এক স্বর্গীয় ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার টানে সে ঈদের দিন আমার পথ চেয়ে বসে থাকত। আমি গেলে তবেই খেত। আমি যখন মেডিকেলে পড়ি, রাণীর তখন বিয়ে হয়ে গেল। রাজশাহীর কোনো এক গ্রামে, এক ধনাঢ্য পরিবারে। আর দেখা হয়নি। “তোমরা ভুলেই গেছ, মল্লিকাদির নাম, সে এখন ঘোমটা টানা রাখাল বধূ দূরের কোনো গাঁয়” গানটা যখন শুনতাম, তখন আমার রাণীর কথা খুব মনে পড়ত।

বছর তিনেক আগে রোজার ঈদ করেছিলাম বাংলাদেশে। ঈদের পরের দিন স্কুলের এক ছোট বোন শেলী দাওয়াত দিল। আমি আর শাহজাদা গেলাম। কত কী রান্না করেছে ও। কোনো রক্তের সম্পর্ক নয়, শুধু এক কলোনিতে থাকতাম।একই স্কুলে পড়তাম। তার জন্য এত আয়োজন? এ যেন জন্ম জন্মান্তরের আপনজন। মনটা কেমন করে ওঠে। শেলী তার কিছু বান্ধবীদেরও ডেকেছিল। তাদের মাঝ থেকে একজন বলে উঠল,

- আফতাব ভাই, আমি রেণু, রাণীর ছোট বোন।

চমকে তাকাই, রাণীর বোন? খুব ছোট্টটি দেখেছি। এখন রমণী হয়ে গেছে, চিনতে পারিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলি,

- ভাল আছিস রেণু? রাণী কেমন আছে? বিয়ের পর ওকে আর দেখিনি!

- বড় আপা তো আমাদের বাসায়। আপনি আসবেন শুনে খুব আসতে চেয়েছিল। অসুস্থ। আসতে পারল না। আপনাকে একবার দেখতে চেয়েছে।

কতকাল ওকে দেখি না। এখনও কি সেই আগের মতই আছে? কী হয়েছে ওর? বুকের ভেতর এক নাম না জানা পাখি ডানা ঝাপটে ওঠে। প্রায় চল্লিশ বছর পর রাণীকে দেখতে পাবো। তাড়াহুড়া করে খাওয়ার পাট চুকিয়ে আমি আর শাহজাদা রেণুকে সাথে নিয়েই গেলাম ওদের বাসায়।

আমরা বসে আছি ড্রইংরুমে। কিছুক্ষণ পর ধীর পায়ে মধ্য বয়সী যে নারী এলো ঘরে, তাকে আমি চিনতে পারি না। গায়ের সোনা রঙ পুড়ে তামাটে। শরীরের ভাজে ভাজে বয়স আর অসুখের ছাপ। আমি যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারি না। আমি যেন কথা বলতেও ভুলে যাই। রাণীই প্রথম কথা বলে,

- ভালো আছিস আফতাব?

ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলি,

- শরীরের এ কী হাল করেছিস তুই? 

- কী করব ভাই? উত্তর বঙ্গের রোদে পুড়ে, নানা রকম রোগে ভুগে, এমন হয়ে গেছিরে! তুই তো কত বড় ডাক্তার, দে না এমন কোনো ওষুধ, যেন আগের মত হয়ে যাই। 

আমার মুখে কোনো কথা সরে না। আহা, সত্যি যদি কোনো যাদুর ওষুধ খুঁজে পেতাম! যদি ফিরিয়ে দিতে পারতাম রাণীর হারানো সৌন্দর্য আর আমি ফিরে পেতাম আমার হারানো শৈশব! আহা, যদি ফেলে আসা সেই দিনগুলিতে আবার ফিরে যেতে পারতাম!  আমার চোখ ভিজে ওঠে। আমি দুহাত বাড়িয়ে দেই। রাণী এসে আমার কাঁধে মাথা রাখে। ঘরের ভেতর ওর ছোট বোন, ওর ছোট ভাই, ওর দুই যুবক ছেলে, কিশোরী মেয়ে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমন অপূর্ব দৃশ্য অবাক চোখে দেখে। ওদের অভিধানে এমন ভালোবাসার হয়ত কোনো সংজ্ঞা নেই।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল