বিনোদন ডেস্ক:
ডুবোযান টাইটান দুর্ঘটনায় পাঁচ আরোহী নিহতের ঘটনায় মুখ খুলেছেন অস্কারজয়ী সিনেমা ‘টাইটানিক’–এর নির্মাতা জেমস ক্যামেরন। ঝুঁকির ব্যাপারে ডুবোযানের নির্মাতাদের আগেই অনেকে সতর্ক করেছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, টাইটানের বহিরাবরণের গঠনের ত্রুটি সম্পর্কে তিনি আগেই সন্দিহান ছিলেন। সে কথা নির্মাতাদের অনেকে জানিয়েছিলেনও। তবে জোরালো আপত্তি না তোলার জন্য এখন তাঁর আফসোস হচ্ছে।
হলিউড নির্মাতা জেমস ক্যামেরন নব্বইয়ের দশকে টাইটানিক সিনেমা নির্মাণ করেন। সিনেমা নির্মাণের আগে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গভীর সমুদ্রে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে ক্যামেরন ৩৩ বারের মতো আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে গিয়েছিলেন। ক্যামেরন ‘ট্রাইটন সাবমেরিনস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানেরও মালিক। এই প্রতিষ্ঠানটিও গভীর সমুদ্রে পর্যটনের সেবা দেয়।
ক্যামেরন বলেন, গত রোববার টাইটান যখন নিখোঁজ হয়, তখন তিনি একটি জাহাজে ছিলেন। সোমবার পর্যন্ত তিনি টাইটানের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। যখন তিনি জানতে পারেন, সাবমেরিনটি একই সময়ে নেভিগেশন ও যোগাযোগ উভয়ই হারিয়েছে, তখনই তিনি একটি বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছিলেন।
ক্যামেরনের ভাষায়, ‘ঘটনাটি জানার পর আমার মাথায় প্রথমেই যে বিষয়টি এসেছিল, তা হলো— প্রচণ্ড চাপে চুপসে যাওয়া।’
এরপর ক্যামেরন সাবমেরিনটির নির্মাণ ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছে। ক্যামেরন বলেন, ‘আমি যখন শুনলাম ওশানগেট একটি কার্বন ফাইবার ও টাইটানিয়াম দিয়ে সাবমার্সিবল তৈরি করছে, তখনই বলেছিলাম, এটি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এসব উপাদান দিয়ে ডুবোযানের বহিরাবরণ তৈরি করলে প্রচণ্ড চাপের সময় পেঁয়াজের খোসার মতো স্তরগুলো খুলে যেতে পারে এবং অতিসূক্ষ্ণ ছিদ্র দিয়ে পানি চুঁইয়ে ভেতরে ঢোকার আশঙ্কাও থাকে।’
ক্যামেরন রয়টার্সকে বলেন, ‘এভাবে সাবমার্সিবল তৈরি করার ধারণাটা ভয়ংকর। তবে তখন ভেবেছিলাম, অন্যরা আমার চেয়ে নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান। তাঁরা যে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন সেটি নিয়ে আমি কখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিনি।’
যদিও কী কারণে টাইটানে পানির চাপে দুমড়ে মুচড়ে গেছে, তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে জেমস ক্যামেরনের ধারণা, কার্বন ফাইবার ও টাইটানিয়ামের খোলসের কারণেই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
ক্যামেরন এই দুর্ঘটনাকে ১৯১২ সালের টাইটানিকের দুর্ঘটনার সঙ্গে মিলিয়েছেন। তাঁর মতে, দুর্ভাগ্যবশত দুটি দুর্ঘটনাই ঘটেছে পূর্ব সতর্কতা না মানার কারণে। ক্যামেরন জানান, মার্কিন কোম্পানি ওশানগেটকে ২০১৮ সালের মার্চে মেরিন টেকনোলজি সোসাইটি সতর্ক করেছিল। এ ছাড়া সেসময় কোম্পানিটির কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই পদত্যাগ করেন। এমনকি এর মধ্যে একজনের দেওয়া চিঠিতেও সেময় কোম্পানিটিকে সতর্ক করা হয়েছিল। এ ছাড়া নাম উল্লেখ না করে অনেকেই তখন ওশানগেটকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছিল বলে জানান ক্যামেরন।
শুধু ক্যামেরন নয় মার্কিন আদালতের প্রকাশিত রেকর্ডে জানা যায়, ওশানগেটের সাবেক এক কর্মকর্তা ২০১৮ সালের প্রথম দিকে ডুবোযানটির নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। রেকর্ড অনুসারে, কোম্পানির মেরিটাইম অপারেশন ডিরেক্টর ডেভিড লোকরিজ একটি তদন্ত প্রতিবেদনে এমন উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন।
পাওয়া গেল টাইটানের ধ্বংসাবশেষ, বেঁচে নেই কেউপাওয়া গেল টাইটানের ধ্বংসাবশেষ, বেঁচে নেই কেউ
গত রোববার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পানির নিচে ডুবোযানে চড়ে রওনা হয় অভিযাত্রী দলটি। ব্রিটিশ অভিযাত্রী হামিশ হার্ডিং ছাড়াও এই দলে ছিলেন পাকিস্তানি বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ ও তাঁর ১৯ বছর বয়সী ছেলে সুলেমান। এ ছাড়া চালক এবং একজন গাইডও ছিলেন ডুবোযানটিতে। তারা প্রথমে একটি জাহাজে চড়ে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি গিয়েছিলেন। পরে ওই জাহাজ থেকে ডুবোযানে চড়ে ধ্বংসাবশেষের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠে মূল জাহাজের সঙ্গে ডুবোযানটির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
চার দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার ডুবোজাহাজটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার কথা জানিয়েছে মার্কিন কোস্টগার্ড। এদিন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে পাঁচ আরোহীর মৃত্যুর কথা জানানো হয়। গত রোববার পাঁচ আরোহীসহ সাবমেরিনটি পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সাগরের তলদেশ পর্যটন সংস্থা ওশানগেট।
যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ড এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের আশপাশে টাইটান সাবমেরিনের বড় পাঁচটি টুকরোর সন্ধান পাওয়া গেছে। সাবমেরিনটি বিস্ফোরিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে কখন সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে, সে বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর শীর্ষ এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, গত রোববার ওই সাবমেরিন নিখোঁজ হওয়ার কিছু পরই অন্তর্মুখী বিস্ফোরণ হয়েছিল। একটি গোপন অ্যাকুস্টিক মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে বিষয়টি রেকর্ড করা হয়।
জেমস ক্যামেরন ২০১২ সালে ‘ডিপ সি চ্যালেঞ্জার্স’ নামে একটি ডুবোযানে চড়ে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে গিয়েছিলেন। ওই সময়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘আপনি পৃথিবীর এমন এক জায়গায় যাচ্ছেন যেখান থেকে যোগাযোগ করা কঠিন। এটা এমন না যে আপনি জরুরি সংস্থাকে কল দিলেন আর তাঁরা আপনাকে উদ্ধার করতে চলে এল।’
রুশ মালিকানাধীন একটি সাবমার্সিবলে চেপে ১৯৯৫ সালে প্রথমবার সাগরের তলদেশে গিয়েছিলেন ক্যামেরন। উদ্দেশ্য ছিল টাইটানিক সিনেমার জন্য ফুটেজ ধারণ করা।
এমআই