ডা. আফতাব হোসেন :
২০০৪ সাল। বছর খানেক হয়, বউ বাচ্চা নিয়ে ইংল্যান্ডে থিতু হয়েছি। বার্মিংহামের পাশে উলভারহ্যাম্পটন নামে এক ছোট্ট শহরে নিউ ক্রস হাসপাতালে চাকরী করি। হাসপাতাল একোমোডেশনেই থাকি। সেবার ডিসেম্বর মাসে রোজা পড়ল। ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডে কড়া শীত। সারাদিন ঝিরিঝিরি তুষার নয়ত টিপটিপ বৃষ্টি। আকাশ ঢাকা থাকে ধূসর মেঘে। কালে ভদ্রে সূর্যদেব একটু উঁকি দিয়েই মুখ ঢেকে দেন মেঘের চাঁদরে। বিকেল চারটা না বাজতেই আঁধার ঘনিয়ে আসে। সূর্য ডোবা দেখে নয়, ঘড়ি দেখেই ইফতার করি। ছোট্ট দিন, অনায়াসে কেটে যাচ্ছিল শীতের দেশে প্রথম রোজার মাস। বাঁধ সাধল ঈদ নিয়ে।
উনত্রিশ রোজা চলছে। সারাদিনে একবারও সূর্যের দেখা মেলেনি। সারা ইংল্যান্ড জুড়ে ভারি তুষারপাত চলছে। বাড়ি ঘর, রাস্তা ঘাট, গাছ গাছালি সব ধবল সাদা। বাংলাদেশের মানুষ আমি। সারা জীবন চাঁদ দেখে রোজা রেখেছি। চাঁদ দেখেই ঈদ করেছি। মুখ ব্যাদান করা এই ছাই রঙা আকাশে আজ সারা দেশে কোথাও চাঁদ দেখার সম্ভাবনা নাই। আর চাঁদ দেখা না গেলে কাল ঈদও হবে না। রোজা ত্রিশটাই হবে। তবুও সন্দেহ কাটাতে ম্যানচেস্টারে এক পাকিস্তানী ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করলাম। সেও জানাল, মেঘের জন্য যেহেতু কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি, হাদিস অনুযায়ী ত্রিশ রোজা পূর্ণ করতে হবে। পরশু ঈদ। এমন সময় আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল। লন্ডন থেকে এক বাংলাদেশী বন্ধুর ফোন।
- ঈদ মুবারক। কাল ঈদ।
- বলেন কী ? তবে যে ম্যানচেস্টার থেকে এক পাকিস্তানী বন্ধু বলল, ঈদ পরশু।
- ওহ। ওরা তো চাঁদ দেখে ঈদ করে।
- তাই তো করা উচিত। একটা হাদিস আছে না? “চাঁদ দেখে রোজা রাখো, চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ্গ”।
- তা জানিনা ভাই, এখানে সবাই সৌদি আরবের সাথে মিলিয়ে ঈদ পালন করে।
কোন সুদূরে সৌদি আরব, ওদের সাথেই মিলিয়ে করব ঈদ? আমি তো মহা দুবিধার মধ্যে পড়ে গেলাম। সারা জীবন শুনেছি, ঈদ চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। বুঝতে পারছি না, কাল রোজা রাখব নাকি ঈদ করব? যদি ঈদের দিন রোজা রাখি, তাহলে হারাম হবে। আবার যদি রোজার দিনে রোজা না রেখে ঈদ করি, তাহলে ফরজ তরক হবে। ভারি সমস্যায় পড়ে গেলাম। শেষে বার্মিংহামের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হাফেজ আঃ করিমকে ফোন করলাম। আমার ফোন পেয়েই খুশি খুশি গলায় বললেন,
- ঈদ মুবারক দকতোর ছাহাব।
- জ্বি, শুকরিয়া। আপকো ভি ঈদ মুবারক। হ্যাভ ইউ সিন দ্যা মুন?
- ইউ ডোন্ট নিড টু সি দ্যা মুন ফিজিক্যালি।
হাফেজ সাব কয় কী ? এমন আচানক কথা জিন্দেগীতে শুনি নাই। ঈদ করার জন্য চাঁদ দেখার দরকার নাই? অথচ আরবি মাস তো চাঁদ দেখার উপরই নির্ভরশীল! আমি তাকে আগের হাদিসটি বলি। শুনে হাফেজ সাহেব হেসে বললেন,
- সহি হাদিস। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে ঈদ করো। কিন্তু যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে গণনায় ৩০ পূর্ণ করে নাও।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০০)
- তবে তো হয়েই গেল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি। এই হাদিস অনুযায়ী তো রোজা ত্রিশটাই হওয়া উচিৎ। তাহলে কাল ঈদ হয় কেমন করে ?
- কিন্তু চাঁদ তো সৌদি আরবে দেখা গেছে।
- সে তো অন্য দেশ। আমরা তা মানব কেন ?
- রাসুল (সঃ) চাঁদ দেখতে বলেছেন। কোন দেশ বা কোন এলাকা থেকে দেখতে হবে তা তো বলেননি। আল্লাহ তালা একটাই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। একটাই সূর্য, একটাই চন্দ্র। সেই সূর্য, সেই চন্দ্র কখন কোথায় অবস্থান করবে, তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পৃথিবীটাকে আমরা মানুষেরাই বিভিন্ন সীমা রেখায় ভাগ করেছি। একই পৃথিবীতে, একই চাঁদের জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে ঈদ হবে, এটা তো কোনো যুক্তির কথা নয়।
- কিন্তু পৃথিবীটা তো গোল। এই আকৃতির জন্যই তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় সূর্য ওঠে, চাঁদ দেখা যায়।
- তা ঠিক। যেমন ধরো সৌদির চাইতে আমরা তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। তাই আমরা সৌদির তিন ঘণ্টা পর ইফতার করি। তিন ঘণ্টা পর ঈদ শুরু করব। তাই বলে মেঘের কারণে সাতাশ ঘণ্টা পর ঈদ হবে, এটা কী ঠিক ?
- তাহলে যে উনি এরশাদ করেছেন, মেঘের কারণে চাঁদ দেখা না গেলে রোজা ত্রিশটা পূর্ণ করো।
- দেখো, আজ থেকে চৌদ্দ শো বছর আগে খালি চোখে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আর যেহেতু হিজরি মাস চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। তাই তিনি চাঁদ দেখার উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু এই বিজ্ঞানের যুগে আ্যস্ট্রোনোমিক্যালী ইউ কান আডেন্টিফাই হার একজ্যাক্ট লোকেশন। কোন সময় কোথায় তাকে দেখা যাবে, আগে থেকেই ক্যালকুলেট করে বের করা যায় কিংবা টেলিস্কোপ দিয়ে দেখা যায়। রাসুল (সঃ) এর যুগে তো টেলিস্কোপ ছিল না। তাই তিনি চাঁদ দেখে রোজা রাখতে বলেছিলেন।
- কিন্তু রাসুল (সঃ) এর পরবর্তী সময়ে, সাহাবাদের যুগে তো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে ঈদ পালিত হয়েছে।
- তা হয়েছে। কারণ তখন যোগাযোগ মাধ্যম এত উন্নত ছিল না। এক দেশের খবর আর এক দেশে পৌঁছাতে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যম ছিল না। এখন তো মুহূর্তে খবর পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায়। তিনি তো এও বলেছেন, “আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে এমন এক ব্যক্তির চাঁদ দেখাই যথেষ্ট, যার দ্বীনদার হওয়া প্রমাণিত অথবা বাহ্যিক ভাবে দ্বীনদার হিসেবে পরিচিত।—সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৪০”।
এই দ্বীনদার ব্যক্তি একই এলাকার নাকি ভিন্ন এলাকার, একই দেশের নাকি ভিন্ন দেশের, তা তো বলেন নি।
হাফেজ সাহেবের যুক্তি আমি খণ্ডাতে পারি না। কিন্তু আমার ধর্মান্ধ মন তাতে সায় দিতে চায় না। আমি একগুঁয়ে সুরে বলি,
- একটা নয়, একাধিক সহি হাদিসে এই মেঘের কথা এসেছে। ফিজিক্যালি চাঁদ দেখার কথা এসেছে। তা যদি না মানি, তাহলে তো বিদআত করা হয়ে যাবে।
- তুমি কিন্তু বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও অবৈজ্ঞানিক চিন্তা করছ ডাক্তার। অন্ধের মতো অযৌক্তিক কথা বলছ। এসো, তোমাকে ব্যাখ্যা করে বলি। বিদআত অর্থ নতুন পদ্ধতি, নিয়ম বের করা, আগের নমুনা ছাড়া নতুন কোন বস্তু বানানো। শরিয়ত এর পরিভাষায় "এমন বিষয় উদ্ভাবন করা যা নবী করিম (সা:) এর সময়ে ছিল না”। সে হিসেবে তো অনেক কিছুই বিদআত। যেমন হযরত ওমর (রাঃ) বিশ রাকাত তারাবীহ নামায নিয়মিত জামাত সহকারে আদায়ের এক নতুন পদ্ধতি চালু করেছিলেন, যা নবীজির (সাঃ) সময়ে ছিল না। ইটের তৈরি মসজিদ, মাইকে আজান, কোরআন একত্রীকরণ, হাদিস সংকলন, গাড়িতে ভ্রমণ, এসব কিছুই নবিজীর (সঃ) ছিল না। এ সবই বিদআত। কিন্তু এগুলো ইসলামের মূল নীতির সাথে সাংঘর্ষীক নয় এবং জনকল্যাণ মূলক। একে বলা হয় বিদআত এ হাসানা বা ভালো বিদআত। আবার বিদআত এ সাইয়া বা মন্দ বিদআত হল যা ইসলামের মূল নীতির সাথে সাংঘর্ষীক, যেমন, খারেজী, কাদেরিয়াহ, আহমদিয়া সম্প্রদায়, মুহররমের তাজিয়া, মাজারে মান্নত, ওরস, ইত্যাদি। এবার কিছু উদাহরণ দেই, নবীজী উটের কাফেলা যদি মরুভূমিতে ধূলি ঝড়ে আক্রান্ত হত, তবে তিনি সফর থামিয়ে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতেন। এটা নবীর সুন্নত। কিন্তু তুমি যদি এখন ট্রেনে ভ্রমণ করো, আর ধূলি ঝড় ওঠে, নবীর সুন্নত পালন করতে যেয়ে তুমি কি ট্রেন থামাতে বলবে ? আবার নবীজীর সময়ে সাগর খুব উত্তাল থাকলে কাঠের তৈরি জাহাজ ছাড়ত না। কিন্তু এখন বিশাল বিশাল সব ক্রুজ শিপ কি উত্তাল সাগরকে ভয় পায় ? পায় না। সেই রকমই কোনো যন্ত্রের সাহায্যে যদি মেঘের আড়ালে চন্দ্রের অবস্থান জানা যায়, আর সেই হিসেবে চন্দ্র মাস গণনা হয়, তাহলে তা খারাপ বিদআত হবে কেন ? এটা তো ইসলামের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষীক নয়। বরং কল্যাণকর, কারণ এতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ বিজ্ঞান সম্মত এক অনন্য নীতি অনুসরণ করবে। তুমি মুসলমান হয়ে বিজ্ঞানের সকল সুফল ভোগ করবে, তাতে অন্যায় হবে না, শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে চাঁদের অবস্থান জানলেই গোমরাহ হয়ে যাবে, এটা তো মুসলমানদের দ্বৈত নীতির পরিচায়ক।
আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম হাফেজ সাহেবের কথা। তার প্রতিটি কথা যুক্তি সম্মত এবং সত্য। অস্ফুটে বলি, বেশক, বেশক। তিনি আবার বলেন,
- ইসলামে কোনো সীমারেখা নেই। সব মুসলমান এক জাতি। মক্কার কাবা শরীফ হল মুসলমানদের জন্য কেন্দ্রবিন্দু। আমরা কাবাকে কেন্দ্র করেই সিজদায় অবনত হই। সেখানে যেদিন ঈদ হবে, সেই হিসেবেই সব মুসলমানকে সময়ের ব্যবধান ঠিক রেখে পর্যায়ক্রমে রোজা রাখতে হবে, ঈদ করতে হবে। ঈদুল আজহার কথা ধর, বলা হয়েছে, আরাফাতের পরের দিন পশু কোরবানি কর ও ঈদুল আযহা পালন কর। সারা পৃথিবীতে আরাফাতের ময়দান একটি এবং আরাফাতের দিনও একটি। নয়ই জুলহাজ্জ্ব। তাহলে দশই জুলহজ্জ ঈদুল আযহা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে হবে কোন যুক্তিতে? মুসলমানকে গোঁড়ামি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। সাইন্টিফিক মেথডকে গ্রহণ করতে হবে।
আজ খবরের কাগজে দেখলাম, সন্ধ্যা নামার আগেই এবার ৩০ রোজা হবে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল-ইস্ট মনিটর।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্যোতির্বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে সৌদি আরবে এবারের ঈদের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশটির ইতিহাসে এবারই প্রথম এ ধরনের ঘটনা ঘটলো। এতদিন ধরে চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করেই ঈদের তারিখ নির্ধারণ করা হতো সেখানে। (যুগান্তর; ১১ মে, ২০২১)। ইউরোপ, আমেরিকার মুসলমানরা অনেক আগে থেকেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এবার সৌদি আরবও করল।
বাংলাদেশে এখনও আমরা জানি না, কবে হবে ঈদ, বৃহস্পতিবার না শুক্রবার? নির্ভর করছে চাঁদ দেখা কমিটির উপর। আমরা কবে চর্ম চক্ষে চাঁদ দেখার উপর নির্ভর না করে এই বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করব ?