সময় জার্নাল ডেস্ক:
বাংলাদেশের ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি এখন আর কোনো স্বপ্ন বা উচ্চাভিলাষ নয়, বরং অগ্রগতির ধারাাবাহিকতায় সময়ের অপেক্ষায় বাস্তবতার প্রতিফলন মাত্র। ২০৪০ এর আগেই বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে। উদীয়মান পাওয়ার হাউস বা শক্তিকেন্দ্র, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অনন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতি, আস্থা এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অদম্য উদ্দীপনায় ট্রিলিয়ন ডলার বা লাখ কোটি বা এক হাজার বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ হবে বিশ্বের নবম বৃহত্তম বাজারও।
তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে শুরু করে নানা কিসিমের নেতিবাচক তকমা গায়ে লাগা বাংলাদেশ আগামী দশকে একটি শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এত সীমাবদ্ধতার পরেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ রেকর্ড হয়েছে এবং পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে ১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। এই পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেলে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দাঁড়াবে ১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮-৯%-এ বৃদ্ধি পেলে এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে তা ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কাজের উপর ভিত্তি করে কানাডিয়ান ফার্ম ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ ভারতের পরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ছিল এবং বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে ৩৫তম স্থানে ছিল। মহামারি ও যুদ্ধ নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ ২০১৫ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়ার সবগুলো মানদণ্ড পূরণ করেছে এবং ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পথে আছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার রূপকল্প সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের (বিসিজি) সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে ৩ কোটি ৪০ লাখের ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে বাংলাদেশ। দ্রুত বর্ধনশীল মধ্যবিত্ত ও স্বচ্ছল শ্রেণিই এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখবে। ২০২০ সালে এ বাজারের আকার ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ ভোক্তার।
বিসিজির মতে, বাংলাদেশের শক্তিকেন্দ্রের পিলার আটটি। সেগুলো হচ্ছে দৃঢ় আশাবাদ, ভোক্তাশ্রেণির উত্থান, ক্রমবর্ধমান তরুণ কর্মশক্তি, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা বা ঘাতসহতা, ডিজিটাল অর্থনীতির গতি, সরকারি বিনিয়োগ, বেসরকারি খাত, উদীয়মান গিগ অর্থনীতি (ইন্টারনেটভিত্তিক খণ্ডকালীন কাজ)।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি সম্প্রসারণশীল বেসরকারি খাত। বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনেক বড় হয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোও ভালো করছে। বাংলাদেশে এখন স্টার্টআপ কোম্পানির সংখ্যা ১ হাজার ২০০। স্টার্টআপগুলো বিভিন্ন খাতে ব্যবসা করছে, যার মধ্যে আছে প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক সেবা, ই-কমার্স ও লজিস্টিকস। গত কয়েক বছরে আরও কয়েকটি কোম্পানি ইউনিকর্ন হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়েছেঅ স্টার্টআপ খাত ৭০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে। সরকারও স্টার্টআপ বাংলাদেশ নামে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিল গঠনের মাধ্যমে খাতটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে।
এদিকে, লন্ডন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে বাংলাদেশ ২০৩৭ সালের মধ্যে ১৯১টি দেশের মধ্যে বিশ্বের ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে।
সিইবিআর এর মতে, বাংলাদেশ বর্তমানে এই অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং বর্তমান মূল্যে ১.৬২৮ বিলিয়ন ডলার। জিডিপি আকারের সাথে ২০৩৭ সাল পর্যন্ত এই গতি বজায় থাকবে।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বড় কারণ বিনিয়োগের জন্য আকর্ষনীয় জায়গা। বর্ধনশীল স্থানীয় অর্থনীতি, অন্তত ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে শুল্কমুক্ত রপ্তানি, উদ্বৃত্ত সস্তা শ্রম, উচ্চমানের পোশাকপণ্যের সুযোগ, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাত এবং ডিজিটাল অর্থনীতি সহ নানা কারণে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয়।
এছাড়া দেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশই মধ্যবিত্ত, এ জনসংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে। ২০২৫ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশমানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হবে।
সরকার দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে এটিও বিনিয়োগ পেতে বড় ভূমিকা রাখবে। সবচেয়ে বড় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর (বিএসএমএসএন) নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের কাছে,মিরসরাইয়ে। এছাড়াও রাষ্ট্রচালিত ৪ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে জমি পেতে পারে। এছাড়াও জাপানি, ভারতীয় ও চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য ডেডিকেটেড অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে এবং ডেডিকেটেড অঞ্চলে জন্য অন্য যেকোনো আগ্রহী দেশকে স্বাগত জানিয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চীন ও পঞ্চম ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক সহজ। এক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে পণ্য বিক্রির পাশাপাশি পাশের দেশগুলোকেও বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। এতে করে বাংলাদেশ হবে এ অঞ্চলের বৃহৎ এক বিজনেস হাব।
৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ দেশে এরইমধ্যে বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দরের একটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। অন্যদিকে ২০২৬ সালে পুরোদমে চালু হওয়া এ অঞ্চলের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ি বাংলাদেশের বাণিজ্যখাতে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে। মাতারবাড়ি থেকে ভারতের উত্তরপূর্ব অঞ্চলের প্রদেশগুলোর দূরত্ব হবে মাত্র ১০০ কিলোমিটার, যা ভারতের বাজারেও বাংলাদেশে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাড়তি সুবিধা দেবে।
২০২২ সালের বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের ট্রিলিয়ন ডলার প্রাইজ শীর্ষক এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের বাজার। ১৭০ মিলিয়ন মানুষের এই বাজারে ২০২৫ সালের মধ্যে মধ্যবিত্ত ও স্বচ্ছল মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৪ মিলিয়ন যা মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। ২০৪০ সালের মধ্যে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাথাপিছু আয় হবে ৫৮ হাজার ৮০৮ ডলার। একটি দেশের এত বড় সংখ্যক মধ্যবিত্ত মানুষের চাহিদা পূরণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।
অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ বিপুল বিনিয়োগ করেলেও—২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে জিডিপির প্রায় ৬.২ শতাংশ ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য এখনও অনেক কিছুর প্রয়োজন। ঢাকা চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক হিসাব অনুসারে, অবকাঠামোগত চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে বছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। এই চাহিদা বিদেশি অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রকৌশল পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রচুর সুযোগের দরজা খুলে দিয়েছে।
বিপুলসংখ্যক তরুণ কর্মশক্তি বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখার জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশের মানুষের গড় বয়স বর্তমানে ২৮ বছর, যা ইন্দোনেশিয়ায় ৩১, ভারতে ২৯, থাইল্যান্ডে ৩৯, ভিয়েতনামে ৩২ বছর। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় ৩০ বছর। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দুই–তৃতীয়াংশ বা কাজের উপযোগী। এর মানে ১১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ কর্মক্ষেত্রে মূল্য সংযোজনে প্রস্তুত।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা, দ্রুতবর্ধনশীল বেসরকারি খাত, সরকারের সক্রিয় ভূমিকা, ক্রমবর্ধমান তরুণ কর্মশক্তি ও উদীয়মান গিগ অর্থনীতির (ইন্টারনেটভিত্তিক খণ্ডকালীন কাজ) ওপর ভড় করে উদীয়মান পাওয়ার হাউস বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির লক্ষ্যে পৌছাঁবে।
এমআই