মো. জাফর আলী: কোন ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড সুন্দর হলে ছবির সৌন্দর্য যেমন আরো সুন্দররূপে ফুটে ওঠে, ঠিক তেমনই ধর্ম মানুষের জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করে জীবনকে পরিপূর্ণতা দান করে, সুখী ও স্বতন্ত্র করে তোলে। আবার হাজার রকমের ফুল যেমন নানা রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে হরেক রকম সুঘ্রাণ ছড়িয়ে ফুল বাগানকে সার্থক করে তোলে, ঠিক তেমনি পৃথিবীতে বিদ্যমান নানাধরনের ধর্ম বা মতবাদও পৃথিবীকে ফুল বাগানের মত সাজিয়ে যেন সার্থক করে তুলেছে। অর্থাৎ পৃথিবী হলো একটি বাগান, প্রতিটি ধর্ম একেকটি ফুল, প্রতিটি ফুলের ভিন্ন ভিন্ন সুবাস, আর একেক জন মানুষ মৌমাছি হয়ে ধর্ম নামের এই ফুলের পেছনে অমৃত সুধা আহরণে ছুটে চলছে অবিরত। এক তথ্যমতে, পৃথিবীতে এরকম সুঘ্রাণযুক্ত ফুলের(ধর্ম) সংখ্যা ৪ হাজার ৩০০ এরও অধিক।
ধর্মগুলো মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই কালের পরিক্রমায় একে একে আবির্ভূত হয়ে মানব জীবনে স্থান করে নিয়েছে। মানুষ যার যার ধর্মকে ভালোবেসে সাদরে গ্রহণ করেছে, এবং এর আঁচলতলে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের জীবনকে অগ্রগামী করেছে। অনেক সময় মানুষকে এই ধর্মেরই ছায়াতলে এসে ঐক্যের সুর বাজিয়ে শান্তির সুবাতাস ছড়াতে দেখা গেছে। আবার এই ধর্মেরই জন্য কখনো কখনো পৃথিবীতে বড় বড় যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটিয়ে রক্তের সাগর বানাতে দেখা গেছে মানুষকে। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্যও ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে অনেক সময়।
তবে যাইহোক, এখনো অনেক সময় একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে, এক ধর্মাবলম্বীরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষমূলক আচরন করে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে ও শান্তি প্রক্রিয়া বিনষ্ট করার চেষ্টা করে থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্ম অবমাননা ও ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করে বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলে এক ধরনের উশৃংখল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। তারমধ্যে মসজিদ, মন্দির ও গির্জা ইত্যাদিতে সন্ত্রাসী হামলা, ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো, প্রতিমা বা মূর্তি ভাঙচুর, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন বা কটুক্তি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানো এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মীয় বৈষম্যসহ আরো ঘৃণিত অনেক কাজই উল্লেখযোগ্য। যা খুবই হাতাশাজনক।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ওয়ান-ইলেভেনে ধর্মান্ধ ও পথভ্রষ্ট গুটিকয়েক ব্যক্তির মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক ও মানবতাবিরোধী কিছু কার্যক্রম সংঘটিত করার পর বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের পরিমাণ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ- কয়েকজন দোষী ব্যক্তির জন্য পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কেই এক ধরনের দোষের ভার বয়ে বেড়াতে হয়েছে বা হচ্ছে এবং বিভিন্ন স্থানে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে।
কথা হল যে, প্রতিটি ধর্মেই কিছু উগ্র শ্রেণীর লোক থাকে। এদের কারণেই ধর্মীয় সম্প্রীতি আজ প্রায় হুমকির মুখে। এরকম গুটিকয়েক অপরাধীর জন্য পুরো ধর্মীয় সম্প্রদায়কেই দোষারোপ করে কোণঠাসা ও বাড়াবাড়ি করে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করা অন্যায় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন লেখা বা গবেষণাপত্রের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, অধিকাংশ ধর্মই মানবাধিকার লংঙ্ঘন, অকারনে যুদ্ধ-বিগ্রহ, জীব হত্যা, চুরি-ডাকাতি, মিথ্যা কথা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, গীবত করাসহ যেকোন ধরনেরই অসৎ কর্মকান্ডকে কখনোই সমর্থন করে না। বরং অধিকাংশ ধর্মই সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, সত্য কথা বলা, পরোপকার করা, জীবন বাঁচানো, হিংসা না করা ও মানুষের অধিকার রক্ষাসহ অধিকাংশ ভালো কাজের কথাই বলে থাকে সব সময়। এ দিক বিবেচনায় কোন ধর্মকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মতপার্থক্য থাকলেও সকলেরই রক্তের রঙ এক, সবার আবাসস্থল হল পৃথিবী নামক একমাত্র গ্রহ, সবাই একই প্রকৃতির পানি, অক্সিজেন, বায়ু ও সম্পদসমূহ ব্যবহার করে এবং সব মানুষেরই জন্ম হয় মৃত্যুবরণ করবার জন্যে। সবচেয়ে বড় কথা হল যে, এই পৃথিবীটা একক কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়, এখানে সকলেরই নিজস্ব ধর্ম, মত বা স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। সবার ক্ষেত্রেই এরকম কয়েকটি সার্বজনীন, এক ও অদ্বিতীয় চাহিদা বা বিষয়ের কথা ভেবে হলেও ভাতৃত্ববোধ রক্ষার্থে এবং সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে ধর্মীয় বিভেদ থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।
লেখক: মো. জাফর আলী, শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইলঃ mdjaforalip5@gmail.com
সময় জার্নাল/