মো. মাইদুল ইসলাম, নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা, কারা যে ডাকিল পিছে, বসন্ত এসে গেছে’। প্রকৃতির যথা নিয়মেই পুরো দেশের মত ঋতুরাজের ছোয়ায় রঙিন হয়েছে তিতুমীর ক্যাম্পাস। কিন্তু যাদের জন্য বসন্তের এত আয়োজন সেই শিক্ষার্থীরা নেই আজ ক্যাম্পাসে। তাইতো ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে বসন্তের ছোঁয়া , ফুলের সুবাস ছড়ালেও নেই কোন আয়োজন, হৈ-হুল্লোড়।
এ বছর নেই বসন্ত বরণের আগের দিন সন্ধ্যার মিলনায়তনের সামনে আলপনা আঁকার ভিড়। ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে ও মেয়েরা হলুদ শাড়ি পরে বাসন্তী সাঁজে এ বছর ক্যাম্পাসে বসন্ত বরণ করতে আসেনি। কিংবা শহীদ বরকত অডিটোরিয়ামের সামনে মিলেনি বসন্ত বরণ। পাখির ডাক শুনেনি শোনা হয়নি।প্রতিবছর এ সময় নতুন শিক্ষার্থীরা আসে ক্যাম্পাসে। বসন্তের আগমনের সাথে নতুন শিক্ষার্থীরা পায় এক মনোরম ক্যাম্পাস। এমন সময় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে পুরোটা দিন কিন্তু এ বছর শিক্ষার্থীশূন্য ক্যাম্পাসে যেন রংহীন বসন্তের আগমন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের প্রায় একবছর পূর্ণ হতে চলেছে। প্রতি বছর সরকারি তিতুমীর কলেজে বসন্ত বরণের জন্য করা হয় নানা আয়োজনে। তবে এই করোনাকালে বাসায় বসে পুরনো বছরের স্মৃতি রোমন্থন করা আর অনলাইনে ‘শুদ্ধস্বর কবিতা মঞ্চ তিতুমীরের’ বসন্ত বরণের অনুষ্ঠান দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা।
গত বছর বসন্ত বরণের জন্য আগে থেকেই নেয়া হয় বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি। বসন্ত বরণের আগেরদিন সন্ধায় শহীদ বরকত মিলনায়তনের সামনে আঁকা হয় আলপনা। বসন্ত বরণের নোটিশ আগেই জানিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। বসন্ত বরনের দিন সকালে শাড়ী-পাঞ্জাবি পরা শিক্ষার্থীদের আগমনে মুখরিত হতে থাকে ক্যাম্পাস। শুদ্ধস্বর কবিতা মঞ্চের সদস্যরা একে একে পরিবেশন করেন বসন্তের কবিতা, গান, নৃত্য। এভাবেই বসন্তকে বরণ করে নেন তিতুমীরিয়ানরা।
শুধু বসন্তকে বরণ করে নেওয়াই নয়।বসন্তের আগমনে পরিবর্তন হয়ে যায় পুরো তিতুমীর প্রাঙ্গণ। ১১ একর এর ক্যাম্পাসে রয়েছে বিভিন্ন ফুল গাছ। বিজ্ঞান ভবনের সামনের ফুলগাছটার কাগজী ফুল ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বহুগুণে। এর রঙে মোহিত করেনা এমন মানুষ খুজে পাওয়া দুষ্কর।
কিন্তু এবছর নেই বসন্ত বরণ উৎসব। প্রকৃতির নিয়মে ক্যাম্পাসে বসন্তের ছোঁয়া লাগলেও। শিক্ষার্থী শূন্য ক্যাম্পাসে ফুলের লাল রং ও যেন রঙহীন!
বসন্তের এই মনোমুগ্ধকর ক্যাম্পাসে এসে ক্লাস করতে না পেরে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে না পেরে আক্ষেপে পুড়ছে শিক্ষার্থীরা।
শুদ্ধস্বর কবিতা মঞ্চ তিতুমীর'র সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, ঋতুরাজ বসন্ত প্রকৃতির নিয়মেই এসে গেছে। কিন্তু এবছর বসন্ত এক অন্যরকম স্বাদ নিয়ে এসেছে বাঙালির জীবনে।বিশ্বব্যাপি করোনা মহামারির প্রকোপে সব কিছুতেই এসেছে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। গত কয়েক বছর বসন্ত যে রূপ নিয়ে এসেছিলো এবছর এসেছে পুরো ভিন্নতা নিয়ে।
তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে বিগত বছরগুলো নানা আয়োজনের মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করে নিয়েছিলো। বিশেষ করে আমাদের শুদ্ধস্বর কবিতা মঞ্চ পরিবার ‘বসন্ত বরণ’ উৎসব করেই বরণ করে নিতো ঋতুরাজকে। কোকিলের ডাক, সকাল বেলা শিক্ষার্থীদের বাসন্তী সাঁজ, কেউ আবার হিমু- রূপা সাঁজে ক্যাম্পাসে আসতো। অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করতো সবার মাঝে। পুরো ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে বসন্তের আভাস ছিলো।
প্রতিবছর ‘শুদ্ধস্বর কবিতা মঞ্চ’ আয়োজন করে থাকে গান, আবৃত্তি, নৃত্য। এ যেন এক মহা প্রশান্তির পরিবেশ। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উপস্থিতে বাসন্তী বাতাশ মধুর কন্ঠে ‘বসন্ত বাতাসে সঁইগো’সহ নানা রকম গান, কবিতায় মেতে উঠতো তিতুমীরিয়ানেরা।
ভালোই কাটতো বসন্ত কিন্তু হঠাৎ করে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকেই শুরু হলো মহামারি করোনা, মানুষের মাঝে আসলো পরিবর্তন, দূরত্ব তৈরি হলো সবার মাঝে, নেই কোন গণসমাগম, আত্বিক বন্ধনে এসেছে পরিবর্তন। এ যেনো নতুন পৃথিবী, নতুন রূপ। এমন ভিন্ন রূপের প্রভাব পড়েছে এবছর বসন্তের গায়েও।
রবীন্দ্র সরোবরে নেই গানের আয়োজন, রমনার বটমূলে নেই শিল্পীদের আনাগোনা। যে যার অবস্থান থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে যতটুকু সম্ভব হয়েছে বসন্তকে বরণ করে নিয়েছে। আমাদের তিতুমীর ক্যাম্পাসে বরাবরের মত কোন আমেজ ছিলো না, শুদ্ধস্বর অনলাইনে বসন্তকে বরণ করে নিলেও সরাসরি বসন্ত বরণ হয়নি এবছর ক্যাম্পাসে বলে জানান তিনি।
এ যেন উৎসব বিহীন বসন্তের স্বাদ নেয়ার চেষ্টা বাঙালির। তবে বাস্তবতা এবং প্রকৃতির নিয়মেই বসন্ত এসেছে আবার চলে যাচ্ছে। ক্যাম্পাস বন্ধ চোখে পড়ে না রূপা-হিমুদের অথবা বাসন্তী সাঁজে কাপলদের। ঢাকার ইট বালুর শহরে কোকিলের ডাক শোনা সৌভাগ্যের বিষয় তবে আমাদের ক্যাম্পাসে বসন্ত আসলেই কোকিলের ডাক শোনা যায়। এবছরও শুনেছিলাম আর হৃদয়ের বাসন্তী স্বাদ নেয়ার অপচেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আমি একজন ক্ষুদ্র সংগীত প্রেমি হিসেবে এমন বসন্ত মেনে নিতে পারছি না। যে বসন্তে গান গাইতে পারিনি গলা ছেড়ে সেই বসন্তের তৃপ্তি কোথায়...।
রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আফরোজা আক্তার তন্বী কবির ভাষায় বলেন, ‘আজ ফাগুনে আগুন লাগে, পলাশে শিমুলে অজয়শীলায় কংসাবতী,দামোদরের কূলে’। তবে প্রতিবারের মতো এবারের ফাগুনে আগুন লাগেনি। ঋতুরাজ বসন্তকে এবার খালিহাতে বরণ করেছে সবাই। অন্যান্য বারের মতো এবার ক্যাম্পাস প্রাঙ্গন সেঁজে উঠেনি। নবীনদের পদচারণায় মুখরিত হয়নি। কোনো আয়োজন ছাড়াই এবার ফাগুন কাটছে।
রসায়ন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে আমাদের ফাল্গুন নিয়ে অনেক প্লানিং থাকে, বিভিন্ন সাঁজ-সজ্জায় তুলনামূলক সব ক্যাম্পাসে এই কিছু আদন্দময় স্মৃতি রচিত হয়, দল বেধে বাসন্তি রঙের শাড়ি পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়ানো, এক সাথে বই মেলা যাওয়া, ফুলেল গন্ধে মনকে মাতিয়ে তোলা, এছাড়াতো স্নিগ্ধ মৃদু বাতাস আছেই। এক কথায় শান্তি প্রিয় দিনগুলোর মধ্যে এই বসন্তের দিন গুলো অন্যতম। বিগত বছরগুলোতে আমরা সবাই এ বসন্তকে উপভোগ করেছি বিভিন্ন মেলায় গিয়ে, সাজসজ্জায়, বই মেলায় ইত্যাদিভাবে।তবে এ বছর ঠিক ঐ রুপ হয়ে উঠেনি। একেতো একুশে বই মেলা এবার হয় নি, তাই, ঐ দিক যাওয়াও হয়নি, অন্যদিকে দল বেধে আগে যেমন হই হুল্লোড় করে ছুটোছুটি হত, এইবার তাতেও সীমাবদ্ধতা চলে আসে'।
ফাগুন মানেই বসন্তের রঙের খেলা। গনিত বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদা হক মনিরার কাছে। তার মতে শীতের জড়তা ভেঙে মনে উৎসবের হাওয়া লাগে এই ফাগুনেই। তিনি বলেন,' বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের প্রস্তুতি থাকে ব্যাপক পরিসরে। তবে এবারের বসন্ত নিজের কাছে বেশ বেরঙিন মনে হচ্ছে। ক্যাম্পাসের মেঝেতে আলপনা দেওয়া, বাহারি রঙে নিজেকে সাজানো, নাচে-গানে-হুল্লোরে দিন কাটানোর সময়টা এবার শুধুই স্মৃতি মাত্র। আমার খুব মনে পড়ে শিক্ষক আর বন্ধুদের সাথে বসন্ত বরণের স্মৃতিগুলো। যে ফাগুনে থাকে আগুনের ছোয়া, সেই ফাগুন এমন নিঃশব্দে চলে যাবে এটা কখনো ভাবি নি। ক্যাম্পাসের ফাল্গুন উৎসবে আমরা দারুণ মজা করতাম। এমন বসন্ত আর না আসুক'।
তবে শেষভাগে বলতে হয় 'যেমন দিন আসে তেমন করেই নিতে হয়। বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয় আর এটাই আমাদের জীবন প্রক্রিয়া।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা মহামারি করোনা একদিন স্বাভাবিক হবে, জনজীবন ক্রমেই স্বাভাবিক হবে, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা শুরু হবে। আগামী বসন্ত আবার আসুক শুভ্রতা নিয়ে সেই আশা তাদের । স্বপ্ন ভেবে পিছু দিন ভুলে নতুন ভাবে এগিয়ে যাক মানুষ, এগিয়ে যাক তিতুমীরিয়ানরা।
সময় জার্নাল/আরইউটি