শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

আজকের দিনটি ছিল ইসরায়েলের জন্য চূড়ান্ত অপমান ও পরাজয়ের

সোমবার, মে ১৭, ২০২১
আজকের দিনটি ছিল ইসরায়েলের জন্য চূড়ান্ত অপমান ও পরাজয়ের

মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা

আজকের এই দিনটি (১৮ মে) ছিল ইসরায়েলের জন্য চূড়ান্ত অপমানের এবং পরাজয়ের একটি দিন। ১৯৬৫ সালের এই দিনে সিরিয়ান সরকার মোসাদ এজেন্ট এলি কোহেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। দামেস্কের মারজাহ স্কয়ারে প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এরপর তার মৃতদেহ ছয় ঘন্টা পর্যন্ত প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেওয়া হয়। বিশ্বের ইতিহাসে কোনো গুপ্তচরের এরকম পরিণতির ঘটনা বিরল।

কে ছিলেন এই এলি কোহেন?
এলি কোহেন ছিলেন ইসরায়েলের বেস্ট স্পাইদের মধ্যে একজন। এলি কোহেন ছিলেন মিসরীয় ইহুদী, কিন্তু তার বাবা ছিলেন সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে আসা। ফলে কোহেনের মিসরীয় এবং সিরিয়ান – উভয় ডায়ালেক্টের আরবির উপরেই ভালো দক্ষতা ছিল।

১৯৫৭ সালে মোসাদে যোগ দেয়ার পর কোহেনকে ধনী সিরিয়ান ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে সিরিয়াতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যেন তিনি ক্ষমতাসীন সিরিয়ানদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন।

কোহেনের নতুন পরিচয় হয় কামেল আমিন সাবেত। তার কভার সাজানো হয় এরকম যে, তিনি মূলত আলেপ্পোর একজন ব্যবসায়ী, যিনি দীর্ঘদিন আর্জেন্টিনায় ব্যবসা করে এখন আবার সিরিয়াতে ফিরে এসেছেন।

কভার স্টোরি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তাকে ১৯৬১ সালে বুয়েন্স আয়ার্সে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে তিনি সমাজের উচ্চপদস্থ সিরিয়ানদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এবং এরপর ১৯৬২ সালে সিরিয়াতে ফিরে গিয়ে তাদের রেফারেন্স সেখানকার ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে কামেল আমিন সাবেত তথা এলি কোহেন প্রায়ই তার বাড়িতে বিশাল বিশাল পার্টির আয়োজন করতেন। সেখানে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ দেশের মন্ত্রীরাও উপস্থিত হতেন।

কোহেন তাদেরকে নারী এবং মদ দিয়ে অর্ধচেতন করে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য আদায় করে নিতেন। তিনি মন্ত্রীদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে তাদেরকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতেন।

দাবি করা হয়, এ সময় তিনি সিরিয়ান জেনারেল এবং বাথ পার্টির সদস্য আমিন আল-হাফেজের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এই আমিন আল-হাফেজই পরবর্তীতে ক্যু করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন।

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, কোহেন আমিন আল-হাফেজের সাথে এতো বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন যে, একপর্যায়ে আমিন তাকে নিজের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করার জন্যও বিবেচনা করেছিলেন।

এই দাবির পক্ষে অবশ্য শক্ত কোনো প্রমাণ মেলে না। সিরিয়ানরা এই দাবি অস্বীকার করে। আমিন আল-হাফেজ দাবি করেন, যে সময়ে তার সাথে এলি কোহেনের সম্পর্কের অভিযোগ করা হয়, সে সময় তিনি সিরিয়ায় বা আর্জেন্টিনায় ছিলেন না, বরং মস্কোতে ট্রেনিংয়ে ছিলেন।

ইতিহাসবিদরাও এ দাবির ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। ধারণা করা হয় ইসরায়েল মোসাদকে সুপার পাওয়ারফুল হিসবে প্রচার করার জন্যই এই দাবির উপর জোর দিয়ে থাকে।

যাই হোক, একটা সময় পর সিরিয়ানরা বুঝতে পারে, তাদের মধ্যে একজন স্পাই আছে। সোভিয়েত টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে তারা দামেস্ক থেকে পাঠানো রেডিও সিগনাল ট্রেস করে এবং কোহেনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বিচার শেষে কোহেনের মৃত্যুদণ্ড হয়।

বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র ধরা পড়া স্পাইদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু ইসরায়েল ব্যতিক্রম। তারা কোহেনের ফাঁসি বাতিলের জন্য ব্যাপক ক্যাম্পেইন চালায়। খ্রিস্টানদের পোপকে দিয়ে অনুরোধ করায়, ফ্রান্সকে দিয়ে হুমকি দেয়ায়।

কিন্তু সিরিয়া সকল চাপকে অগ্রাহ্য করে কোহেনের ফাঁসি কার্যকর করে। ১৯৬৫ সালের ১৮ মে দামেস্কের মারজাহ স্কয়ারে জনসমক্ষে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তার মৃতদেহ ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেয়া হয়। বিশ্বের “শ্রেষ্ঠ” গোয়েন্দাসংস্থা মোসাদের জন্য এটা ছিল চূড়ান্ত হিউমিলিয়েশন।

তবে ধরা পড়ার আগে কোহেন তার নাম ইসরায়েলের ইতিহাসে লিখে রাখার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। তার জেনারেল বন্ধুদের সাথে তিনি একবার গোলান হাইটস পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে ধু-ধু মরুভূমির তীব্র গরমে দাঁড়িয়ে থাকা সিরিয়ান সৈন্যদেরকে তিনি “বুদ্ধি” দিয়েছিলেন, তাদের উচিত কিছু গাছ লাগিয়ে গাছের ছায়ায় বসে বসে বর্ডার পাহারা দেয়া।

নির্বোধ সিরিয়ানরা তার পরামর্শ অনুযায়ী সত্যি সত্যিই গাছ লাগিয়েছিল। সেই গাছগুলোই ছিল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ সিরিয়ার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সরাসরি সেই গাছগুলো লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়ে সহজেই সিরিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল।

তবে বাস্তবে এলি কোহেন যতটা না সফল ছিল, ইসরায়েল এবং ইহুদী প্রপাগান্ডিস্টরা তাকে তার চেয়েও অনেক বেশি সফল, প্রায় সুপার স্পাই হিসেবে প্রচার করে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, কোহেনকে নিয়ে ২০১৯ সালে তৈরি নেটফ্লিক্সের তৈরি ছয় পর্বের মিনি সিরিজ The Spy।

সিরিজে এলি কোহেনকে এমনভাবে চিত্রায়িত করা হয়, যেন তিনিই সে সময়ের সিরিয়ার সকল রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে তার সম্পর্ক ছিল, সিরিয়ার ক্যুয়ের পেছনেও তার হাত ছিল, এমনকি সে সময়ের শিশু ওসামা বিন লাদেনের সাথেও তার দেখা হয়েছিল। 

কিন্তু বাস্তবে এ দৃশ্যগুলোর অধিকাংশই ইসরায়েলি প্রপাগান্ডা। তারা স্বভাবতই বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদেরকে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে, আর আমরাও তাদের এসব প্রপাগান্ডা বিশ্বাস করে দুনিয়ার সবকিছুকেই "ইহুদীদের ষড়যন্ত্র" হিসেবে বিশ্বাস করি, যার ফলে আমাদের মনোবল আরও ভেঙে যায়।

সিরিজে দেখানো ঘটনাগুলো যে অধিকাংশই মিথ্যা প্রপাগান্ডা, সেটা এলি কোহেনকে নিয়ে বানানো আল-জাজিরার একটি ডকুমেন্টারিতেও উঠে এসেছে। 

যেমন সিরিজে দাবি করা হয়, কোহেন নাকি প্রায় সিরিয়ার ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হয়ে যাচ্ছিল। তার সাথে নাকি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আমিন আল-হাফেজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আল-জাজিরা বলছে, এ দাবি অতিরঞ্জিত।

প্রথমত, ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবে এলি কোহেন আর্জেন্টিনায় ছিল ছয় মাস। ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত। আর সে সময় মিলিটারি অফিসার আমিন আল-হাফেজ ছিল মিসরে। 

১৯৬১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সিরিয়া যখন জামাল আব্দুল নাসেরের সাথের কোয়ালিশন ভেঙ্গে দেয়, তখন নাসের হাফেজ আল-আসাদ, আমিন আল-হাফেজ সহ টপ সিরিয়ান অফিসারদেরকে ৪০ দিন পর্যন্ত মিসরে আটকে রাখে।

নভেম্বরে মুক্তি পাওয়ার পর আমিন আল-হাফেজ প্রথমে সিরিয়ায় ফেরত যায়, এরপর তাকে সেখান থেকে আর্জেন্টিনায় ট্রান্সফার করা হয়। ততদিনে এলি কোহেন আর্জেন্টিনা থেকে লেবানন হয়ে সিরিয়াতে প্রবেশ করেছে। 

কাজেই সিরিয়ালে যে দেখানো হয় আর্জেন্টিনায় আমিন আল-হাফেজের সাথে কোহেনের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল, এবং এরপর আমিন আল-হাফেজ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সেই বন্ধুত্বের খাতিরে কোহেনকে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, ওগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

সিরিয়ালে আরও দেখানো হয়েছিল, টপ মন্ত্রী এবং মিলিটারি অফিসারদের সাথে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে এলি কোহেন সিরিয়াতে ক্যু ঘটিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এটারও কোনো ভিত্তি নাই। 

বাস্তবে এলি কোহেনের উপর নির্দেশ ছিল সে যেন ভুলেও বেশি উপরের দিকের কারো সাথে সম্পর্ক স্থাপন না করে। কারণে তাহলেই সে কারো না কারো নজরে পড়ে যাবে, তার গোয়েন্দা পরিচয় ধরা পড়ে যাবে।

গোলান মালভূমিতে গিয়ে গাছ রোপণ করার পরামর্শ দিয়ে এলি কোহেন ইসরায়েলকে ৬৭ সালের যুদ্ধে জিতিয়ে দিয়েছিল বলে যে দাবি করা হয়, আলজাজিরার দাবি অনুযায়ী সেটাও অতিরঞ্জিত। 

কোহেনের পাঠানো কিছু গোয়েন্দা তথ্য অবশ্যই ইসরায়েলের কাজে লেগেছিল, কিন্তু গোলানে তার একটা ছবি দেখিয়েই যেরকম দাবি করা হয় তার সাথে সিরিয়ান টপ মিলিটারি অফিসারদের বন্ধুত্ব ছিল বলেই সে সেখানে যেতে পেরেছিল, সেটা মোটেও সত্য না। সে সময় যে কেউ গোলান মালভূমির ঐ জায়গা পর্যন্ত যেতে পারত।

মূল কথা হচ্ছে, ইসরায়েল এলি কোহেনকে যেরকম হিরো দাবি করে, বাস্তবে সে সম্ভবত সেরকম কিছু ছিল না। বরং সে সিরিয়ান মিলিটারি অফিসারদের হাতে ধরে পড়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসিতে ঝুলেছিল, ইসরায়েলের জন্য যেটা ছিল চরম অপমানজনক। 
কে জানে, হতে পারে সেই অপমান ঢাকার জন্যই ইসরায়েল তাকে “সুপার স্পাই” হিসেবে দাবি করে।

সময় জার্নাল/এসএ


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল