ফাহিম হোসেন
মুহাম্মদ ইকবাল হাসান (ছদ্মনাম)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে ভর্তি হন আরবী বিভাগে। মনোনয়ন পান সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। হলে সিট সংকট থাকায় জায়গা হয় হলের বারান্দায়।
এরপর থেকে এই তিনবছরে হলে আর আসন বরাদ্দ হয়নি। তবুও তার অবস্থার পরিবর্তন আর হয়নি। শুধু ইকবালই নন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বারান্দায় বর্তমানে অবস্থান করছেন তার মতো আর ৭৫ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীরা জানান, বারান্দায় তীব্র গরম আর বৃষ্টির সময় পানি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় বিছানা-আসবাব, বইপত্র। অনিরাপত্তাও একটি বড় ভোগান্তি হয়ে দাড়িয়েছে এখানে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের জন্য। প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান জিনিসপত্র।
সরেজমিনে দেখা যায়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ভবনের দক্ষিণ দিকের অংশে বারান্দায় থাকছেন শিক্ষার্থীরা। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য পুরনো কম্বল ও ব্যানার দিয়ে কৃত্রিম খুপড়ির মতো তৈরী করে নিয়েছেন বারান্দায়৷ তার ভেতরে বেড, টেবিল, ট্রাঙ্ক, বই, জামাকাপড় রাখছেন।
চারিদিক আবদ্ধ থাকায় দিনের বেলাতেও খুপড়িগুলোতে আলোর উপস্থিতি নেই। ফলে, দিনের বেলাতেও শিক্ষার্থীদের কাটাতে হচ্ছে অন্ধকারে। বাতাস চলাচলের কোন সুযোগ নেই। তারউপর ফ্যান না থাকায় ভেতরে একধরনের ভ্যাপসা গরম বিরাজমান।
হল অফিস সূত্রে জানা যায়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সর্বমোট আসন সংখ্যা ৭৪৪ টি। ২০২০-২১ সেশনের আগে প্রতিবছর হলে ২০০ থেকে ২৫০ শিক্ষার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হতো। গুরুতর ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় ২০১৯ সালের পর নতুন কোন শিক্ষার্থীকে মনোনয়ন না দিলেও এখনো সেখানে শিক্ষার্থীদের থাকতে হচ্ছে বারান্দায়। কেউ কেউ এখানে থেকেই শেষ করছেন স্নাতক।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলের বৈধ শিক্ষার্থীদের বাইরে এখানে এমন অনেক অবৈধ শিক্ষার্থী থাকেন যাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে বহু আগেই। ২০০৯-১০, ২০১০-১১ সালের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ এখনও সিট দখল করে রেখেছে। সিনিয়র হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে কেউ একাই দখল করেছেন একটি পুরো কক্ষ। পড়াশোনা শেষ করে হলে থেকে চাকরিও পর্যন্ত করছেন কেউ কেউ।
এছাড়া ডাবল বেডে একাই অবস্থান করা ও নিজের সাথে ছোট ভাই, আত্মীয়কে রাখাসহ অনেকগুলো কারণে হলে সিট সংকট রয়েছে। ফলে হলের বৈধ শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়েই থাকতে হচ্ছে বারান্দায়৷ এসব বিষয়ে প্রশাসনের কোনো নজর নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, রেলস্টেশনের পাশে বস্তিতে মানুষ যেভাবে থাকে, আমরাও সেভাবে থাকছি। এভাবে বারান্দায় থাকায় চাইলেও নিজের কোন বন্ধু বা অতিথিকে হলে নিয়ে আসতে পারি না। আমাদেরকে এভাবে দেখলে তারাও কষ্ট পাবেন। রাতে বৃষ্টিতে হলে সব ভিজে যায় বলে রাত কাটাতে হয় না ঘুমিয়েই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এভাবে থাকছি, কিছু বলার নেই আসলে।
শিক্ষার্থীরা জানান, হলের এখানে থাকা সবসময়ই সমস্যা। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় বৃষ্টির মধ্যে। ব্যানার দিয়ে চারপাশ ঘিরে রাখলেও বৃষ্টির পানি সব ভিজিয়ে দিয়ে যায়। বাতাস বেশি হলে তো অনেককিছু উড়িয়েও নিয়ে যায়। তখন আমাদের অনেকে মসজিদে গিয়ে ঘুমোয়। অনেকে সারারাত জেগে থাকে। গতবছর সিত্রাংয়ের সময় অনেকেই ঘুমোতে পারেনি। প্রচন্ড বাতাস বারান্দায় থাকা লুঙি, চারিদিকে ঘেরার জন্য টাঙ্গানো ব্যানার, বইপত্র অনেককিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়। বিছানাপত্র সব ভিজে যায়। পানিতে বারান্দায় ফ্লোর ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়।
এসবকিছুর সাথে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগতে হয়। বারান্দা হওয়ায় এখানে জিনিসপত্রের কোন নিরাপত্তা নেই বলে জানান তারা।
আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, কোথাও যেতে হলে নিজের সব জিনিসপত্র এভাবে রেখে চলে যেতে হয়। অনেকসময় মূল্যবান বই, ব্যবহার্য উপকরণ, আসবাবও চুরি হয়। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় ছুটির সময়। বিশেষ করে ঈদ এবং গ্রীষ্মসহ বড় ছুটিগুলোতে অনেকেই বাড়িতে চলে যায়। ফলে সবকিছু এখানে খোলামেলা অনিরাপদভাবে পড়ে থাকে। ঈদের পড় বাড়ি থেকে এসে অনেককিছুই আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
বারান্দায় থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য আরও একটা বড় সমস্যা হলের জীর্ণ অবস্থা। সরেজমিনে দেখা যায়, হলের বিভিন জায়গা থেকে ইট সুড়কি ছুটে পড়ে গেছে। যেকোন সময় এসব শিক্ষার্থীদের উপর পড়ে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, রুমগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলে হল কতৃপক্ষ নজর দেন কিন্তু বারান্দার ছাদ বা দেয়ালের কোন ক্ষয়-ক্ষতি হলে তারা তেমন আমলে নেন না।
হলের বৈধ সিটের জন্য বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। গতবছর সিত্রাংয়ের পর সাবেক প্রাধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান শিক্ষার্থীদের সিটের আশ্বাস দিলেও বছর ঘুরে এখনও তার কোন বাস্তবায়ন হয়নি। কোন কোন শিক্ষার্থী ১৪-১৫ বার আবেদন করেও কোন সুফল পাননি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ইকবাল রউফ মামুন বলেন, দেখা গেছে কেউ ডাবল বেডে একা থাকছে, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও হলে থাকছে, কেউ কেউ আবার আত্মীয়-ছোটভাইকে এনে হলে রাখছে। এসব কারণে সিট সংকট তৈরী হয়ে আছে। আমরা একবার রেড দিয়ে কয়েকজন বহিরাগত বের করেছি। আমরা প্রশাসনিকভাবে খুব দ্রুতই এর ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা তাদের ব্যাপারে নোটিশ জারি রাখবো। এরপরও বের না হলে প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নেবো। হলের সময় আসলে খুব বেশি নেই। এই দুইবছর যাতে অন্তত শিক্ষার্থীরা ঠিকভাবে থাকতে পারে।
সময় জার্নাল/এলআর