ডক্টর শোয়েব সাঈদ: পিক্টোগ্রাফে আমলা শব্দটির উৎপত্তি উদরপূর্তি করে ছাদের নীচে হেলান দিয়ে বসে থাকা অলস্য মানবের অবয়ব থেকে। জাপানিদের হিরাগানা,কাতাকানা অক্ষর দিয়ে শব্দ তৈরির পাশাপাশি চীনাদের মত কাঞ্জি বা পিক্টোগ্রাফে চিত্রায়িত করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট শব্দকে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। কাওয়া বা নদীর কাঞ্জিতে ভেসে উঠবে নদীর ঢেউ।
আমলা বা সরকারি কর্মকর্তাকে জাপানিতে বলা হয় কান।
কর্মঠ, আত্মমর্যাদা আর দায়িত্ববোধের জন্যে বিশ্বখ্যাত জাপানীদের জন্যে আমলার ব্যুৎপত্তিগত এই ইমেজটি মোটেও সুখকর ছিলনা। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে রাষ্ট্র আর জনগণের চাহিদার উপর দাঁড়িয়ে জাপানীরা তৈরি করেছে বিশ্বের সন্মানিত আর কার্যকরী এক আমলাতন্ত্র।
আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগলে আত্মহত্যা প্রবণতা জাপানীদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হবার অন্যতম বাধা। আমার এক আমলা বন্ধু বলছিলেন আমলাতন্ত্র একটি গালি। তাঁর সাথে আমার দ্বিমত ছিল, দুর্নীতির রক্ষা কবচ যে আমলাতন্ত্র তা তো গালি নয় বরং একটি রাষ্ট্রের অক্সিজেন।
অপেক্ষাকৃতভাবে দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রেও লালফিতার অপবাদ আমলাতন্ত্রকে বহন করতে হয়। আর এ কারণেই উন্নতদেশে আমলাতন্ত্রকে যেতে হয় ক্রমাগত রিফর্ম বা সংস্কারের মাধ্যমে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে জনগণ এমন কিছু রাজনীতিবিদদের বেছে নেন যারা আমলাতন্ত্রের সংস্কারে থাকেন আপোষহীন। আমলাতন্ত্রের সংস্কারে নিয়োজিত রাজনীতিবিদরা আমলাদের খুব অপছন্দের হলেও উনাদের যোগ্যতার কাছে দিনশেষে আমলাতন্ত্রকে ধর্না দিতেই হয়।
প্রজ্ঞা, মেধা, নীতি নৈতিকতায় রাজনীতিটা যদি প্রাতিষ্ঠানিক না হয়, তখন কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে একটা হট্টগোল লেগেই থাকে। আমলাতন্ত্রের কাছে অন্যায় সুবিধের আবদার থাকলে নিয়ন্ত্রণ করবেন কি করে?
আইসিএস, সিএসএস, বিসিএস ব্রিটিশ সংস্করণের একেকটি নতুন অধ্যায়ের খুব বেশী সুফল কি আমরা পেয়েছি?
ব্রিটিশরা কিন্তু নিজের দেশে নানা সংস্কারে মাধ্যমে এই মেধাবীদের মেধাটুকু রাষ্ট্রের সেবায় কাজে লাগাচ্ছেন। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে আমলাতন্ত্র দিয়ে নানা ফন্দিফিকির, ঝেড়ে নাইবা কাশলাম। দুর্বল স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি সবল আমলাতান্ত্রিক প্রশাসক এসব ফন্দিফিকিরের লাইন অব ক্রেডিট।
আমাদের দেশের আমলারা অবসরের পর নিজেরাই আমলাতন্ত্রের ভিকটিম হন। যে সচিব হাঁচি দিলেই ঘণ্টায় “টেন টু দি পাওয়ার থ্রি” বেগে উনার ফেসবুকে “আলহামদুলিল্লাহ স্যার” জায়গা করে নেয়, উনি অবসরে গেলে পরের দিন থেকেই সেই রমরমা অবস্থা উবে যায়। পাওয়ার প্রাকটিসের বিষক্রিয়া কাউকে ক্ষমা করে না।
শাসক নয়, সেবক হবার পথে আমাদের আমলাতন্ত্রকে হাঁটাবার জন্যে রাজনীতিবিদ বা আমলারা নিজেরাই চেষ্টা করে দেখেছেন কি?
আমাদের পত্রপত্রিকার অসংখ্য উপসম্পাদকীয় দেখবেন অবসরপ্রাপ্ত কেবিনেট সচিব, মুখ্যসচিবদের সুশাসনের নানা রকম প্রেসক্রিপশন দিয়ে। উনারা ক্ষমতায় থাকার সময় কি কোন চেষ্টা করেছেন? চেষ্টা করে থাকলে ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলো কি চিহ্নিত করেছেন?
অন্যায়টাকে অন্যায় বলার ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতার আশ্রয় নিতে অভ্যস্ত হয়ে যায় যে জাতি, তাঁদের উপাচার্যতন্ত্র থেকে আমলাতন্ত্র ক্রমশই জটিলতায় জড়িয়ে যাবে এটাইতো স্বাভাবিক।
লেখক: ডক্টর শোয়েব সাঈদ, লেখক ও গবেষক.