শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

কান্না নিয়ে কথা

বুধবার, মে ১৯, ২০২১
কান্না নিয়ে কথা

সেজান মাহমুদ :

আমি অসম্ভব রকমের কান্নাপ্রবণ মানুষ। দিনে কতোবার যে কাঁদি তার কোন হিসাব নেই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো মানুষ সচারচর যে সব বড় দুঃসংবাদ শুনে কাঁদে আমার তাতে কান্না আসে না। আমি মেডিক্যালের ছাত্রাবস্থায় আমার বাবা তৃতীয়বার হার্ট এটাকে চিরবিদায় নেন। প্রথম দুবা’র মাইল্ড এটাক। দুপুরবেলা আমার হোস্টেলে মেজ আর সেজো ভাই এলেন গাড়ি নিয়ে; বললেন আব্বার শরীর খারাপ, এক্ষুনি সিরাজগঞ্জ যেতে হবে। আমি মুহূর্তে তৈরি হয়ে গাড়ি তে উঠেই বললাম, বাবা মনে হয় বেঁচে নেই। আমার দু’ভাই কাঁদলেন। আমি কাঁদলাম না, যেন জানতাম এমন হবে, কেঁদে কী হবে? তারপর তাঁর জানাজার সময় কপালে হাত রেখে হাউমাউ করে কান্না। 

তারচে অনেক তুচ্ছ বা আপাত তুচ্ছ বিষয় নিতে প্রতিদিন অজস্রবার কাঁদি। একটা সুন্দর গানের সুর, সুন্দর কবিতার লাইন, সুন্দর কোন সিনেমার দৃশ্যে, এমনকি সুন্দর কোন কথা বলতে গেলে কেঁদে ফেলি। আমার নিজের লেখা গান গাইতে আমার ভয়ানক সমস্যা কারণ, আমি গাইতে গেলেই কেঁদে ফেলি। আমার এই কান্নাপ্রবণ মনের চলমান সাক্ষী -তৃষ্ণা। 

অতীতে আমি ভীষণ চিন্তিত ছিলাম। কারণ, অনেক গতবাঁধা ডাক্তার, এমন কি সাইকিয়াট্রিস্ট বলবে “টিয়ারফুলনেস ডিপ্রেশনের সাইন”। তাই নিজেই যেমন গবেষণা শুরু করলাম মনোবিজ্ঞানে কে কী বলে এ নিয়ে, তেমনি পৃথিবী বিখ্যাত কিছু ভিন্নধর্মী মনোবিজ্ঞানীকে জিগ্যেস করেছি এই কান্নাপ্রবণতার কারণ কী, আমার বেলায়। কারণ, আমি বিষন্ন কী না তা জানা জরুরী। 

এগুলো  জানতে গিয়ে প্রায় কান্না বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলাম। যা হোক এ নিয়ে প্রবন্ধ লেখা যায়; কিন্তু সার সংক্ষেপ হলো এরকম: 
মানুষ মূলত কাঁদে অসহায়বোধ করলে, সহমর্মীতা পেতে, তারপর কাঁদে কোন কিছু হারালে, কাঁদে প্রখ্যাখাত হলে, কাঁদে আনন্দে, কাঁদে অন্যের খুশিতে, এরকম নানান কান্নাকে চারভাগে ভাগ করা যায়। 

এক। এটাচমেন্ট ক্রাই বা সংযুক্তির কান্না 

দুই।  সামাজিক কান্না  ( এটার মধ্যে মায়াকান্নাও আছে)

তিন। আবেগ ও নৈতিক কান্না 

চার। কমপ্যাশনেট বা সমব্যাথীতার কান্না

এই চার নম্বরটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কমপ্যাশন কে অনেকে বাংলা করেন ‘করুনা’ যা সম্পূর্ণ ভুল। কমপ্যাশন মানে সমব্যাথী হওয়া, অন্যের কষ্টকে নিজের ভেতরে অনুভব করা। এটা বড় একটা মানবিক বৈশিষ্ট। নানান পরীক্ষা-নিরিক্ষা, ঘন্টার পর ঘন্টা প্রশ্নত্তোরের পর আমার বেলায় রায় হলো আমার মধ্যে তিন এবং চার নম্বর কান্না বেশি। বলাই বাহুল্য কান্না আমাদের জীবনের ফাংশনিং বা কর্মক্ষম থাকার জন্যে অত্যন্ত জরুরী। আমাকে মনেবিজ্ঞানী আরো সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিলেন যা উহ্য রাখলাম 😊। 

কান্না নিয়ে এতো বিস্তারিত লেখার কারণ হলো সম্প্রতি সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ওপরে জুলুম দেখে আমার বন্ধু, জনপ্রিয় লেখক, কবি আনিসুল হক জনসমক্ষে কেঁদেছেন এবং তা নিয়ে মানুষ ট্রল করেছে। সত্যি মানুষের কান্নার মতো গভীর একটি প্রকাশ নিয়েও ট্রল করতে হবে? আমি আনিসুল হককে চিনি বললে ভুল হবে- চিনি এবং বুঝি। তিনি যখন বিখ্যাত কেউ  নন সেই বুয়েটের মিটুন, বইমেলার প্রথম কবিতার বই ‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’, কিম্বা একসঙ্গে ভোরের কাগজে লেখা, আমার তখন রীতিমতো কলাম বেরুতো সেখানে, কবিতা পরিষদ- সব মিলিয়ে আমি হলফ করে বলতে পারি আনিসুল হকের কান্নাটি সহকর্মীর জন্য নির্ভেজাল, অন্তর-উৎসারিত কান্না! কোন ভান নেই তাতে; আছে অসহায়ত্ব! 

আমার বরং আনিসুল হকের মতো ক্ষমতাশালী লেখক, সাংবাদিকসহ বাংলাদেশের বেশিরভাগ লেখক, কবি, শিল্পীদের প্রতি ভয়ানক অভিমান আছে। আপনারা আজকে সহকর্মীর অসহায়ত্বে কাঁদছেন। এই বাংলাদেশে যখন অভিজিৎ, অনন্ত, রাজিব, ওয়াশিকুর, নীলাদ্রী, দীপন, মাহবুব, জুলহাস কে হত্যা করা হয় আপনারা কেউ কাঁদেন নি। এদের অপরাধ ছিল ভিন্নমত আর ভিন্ন বিশ্বাস। কোন অসহায় দরিদ্র মানুষ, সংখ্যালঘু পরিবার, এমনকি (এমনকি বলছি, কারণ আমি ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ) মাদ্রাসার ছাত্রদের ওপরে হামলা হলেও আমার কান্না আসে। এদের প্রত্যেকেই জন্যেই কান্না আসা উচিত আমাদের, যে কোন অসহায় মানুষের ওপরে নিমর্মতার জন্যেই কান্না আসা উচিত। 

না, কেউ ভুলেও ভাববেন না নিজেকে মহান করার চেষ্টা করছি। আমি বরং বেশি অক্ষম। কিন্তু আমার মূল পয়েন্ট হলো আমরা সকলেই যেন নৈতিক আর সমব্যাথী কান্না কাঁদতে পারি। তা যদি আগে থেকেই পারতাম তাহলে আজকের এই অসহায়ত্ব কিছুটা হলেও ঠেকানো যেতো। কেউ দয়া করে কোন কারনে ভুল বুঝবেন না।

--- সেজান মাহমুদ
মে ১৯, ২০২


লেখক পরিচিতি:

সেজান মাহমুদ একজন স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক, গীতিকার, ছড়াকার। পেশাগতভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং শিক্ষক। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনের সহকারী ডিন এবং প্রফেসর হিসাবে কর্মরত।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল