ফাহিম হোসেন, ঢাবি : স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে মেঝে; চারিদিকে ময়লার গন্ধ, দেয়ালে ধূলা আর মাকড়সার জাল। ছাদ থেকে ছুটে পড়েছে পলেস্তারা, প্লেট-বাটি অপরিষ্কার। রান্নাঘরের দেয়াল ও ছাদ তেলতেলে, মেঝে অপরিচ্ছন্ন; দেয়াল ধোঁয়ায় কালচে আকার ধারণ করেছে। এমনটাই দেখা মেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রেজিস্ট্রার ভবনের ক্যান্টিন ঘুরে। ক্যান্টিনের খাবারের মানও ভালো নয় বলে কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন।
এ ছাড়া পুরো প্রশাসনিক ভবনজুড়ে আর কোনো দোকান বা খাবারের জায়গা নেই। কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা খাবারের জন্য প্রায়ই ছুটতে হয় পাশের মাস্টার দা সূর্যসেন হলে। এতে নষ্ট হয় মূল্যবান কর্মঘন্টা।
তবে শুধু ক্যানটিনই নয়, এমন জরাজীর্ণ অবস্থা দেখা যায় পুরো রেজিস্ট্রার ভবনজুড়ে। বিভিন্ন স্থানে জমে আছে ধূলা, জড়ো করে রাখা হয়েছে ভাঙ্গা আসবাবপত্র। বাইরে পড়ে আছে পরিত্যক্ত বাস-কারসহ ইলেক্ট্রিক ভাঙ্গারি যন্ত্রাংশ। এতে নষ্ট হচ্ছে দাপ্তরিক পরিবেশ।
প্রশাসনিক ভবন ঘুরে দেখা যায়, নিচতলার প্রকৌশল শাখার সামনের গলিতে লম্বা সারিতে পড়ে আছে পুরনো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, কাঠ, ইলেক্ট্রিক ভল্ট, বিকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রাংশ। এ ছাড়াও সেখানে নষ্ট হয়ে যাওয়া এসি, ভাঙ্গা কাঁচ ও পুরনো ফাইল স্তুপ করে রাখা হয়েছে।
প্রকৌশল দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. লৎফুর রহমান বলেন, 'সরকারি এক পয়সার জিনিসও কতৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বিক্রি করা যায় না। তাছাড়া, মোটামুটি একটা ভালো অর্থের জিনিসপত্র না জমলে বিক্রি করে লোকসান গুণতে হয়। আমরা সাধারণত দুই বছরের মধ্যেই পুরনো জিনিসপত্র বিক্রি করে ফেলার চেষ্টা করি। করোনার কারণে আমরা দু'বছর কাজই করতে পারিনি। অনেকগুলোও নথিও জমে গেছে। তবে বারান্দায় এবং বাইরে জমা পুরাতন জিনিসগুলো বিক্রির অনুমোদন হয়ে গেছে। নিলামের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।'
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই সামনের ফাঁকা জায়গায় চোখে পড়ে ধুলোবালি জমা কয়েকটি গ্লাসের জানালা, জানালার সাথে কাপড়, বস্তা, রড, এবং ভাঙ্গা জিনিসপত্র পড়ে আছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় এগুলোর উপর ধুলো জমে গেলেও এখনো সরানো হয়নি। ২১২(ক) কক্ষ থেকে শুরু করে ২১৩(ক) পর্যন্ত দুপাশে হাঁটার পথে সারিবদ্ধভাবে আলমারি রাখা হয়েছে। এগুলোতে পুরু ধূলার আস্তরণ।
সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠতেই গেটের সামনে ফাঁকা জায়গায় চেয়ার, টেবিল, আলমিরা, সোফাসহ ভাঙ্গা আসবাবপত্র স্তুপ করে রাখা। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় এগুলোতে জমেছে ধূলাবালি। ৩০৮ নম্বর কক্ষের সামনে পড়ে আছে পুরনো আলমারি, টেবিল; টেবিলের উপর পড়ে আছে ভাঙ্গা কাঁচ। ৩১০ (ক) নম্বর কক্ষ থেকে ৩১২ নম্বর কক্ষ পর্যন্ত ট্রান্সক্রিপ্ট শাখার কাগজ ফেলে রাখা হয়েছে হাঁটার পথেই। অধিভুক্ত ৭ কলেজের কার্যক্রম পরিচালনার নির্ধারিত স্থানে যেতে শিক্ষার্থীদের পার হতে হয় এই পথ, যেখানে দুজন একসঙ্গে হাঁটার সুযোগ নেই।
এ ছাড়াও প্রশাসনিক ভবনের বিভিন্ন অংশে পুরনো আলমারি, কাগজপত্র, ভাঙ্গা আসবাবপত্র, পুরনো নথিপত্র পড়ে আছে। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাভাবিক পরিবেশ। ভবনের উত্তর পূর্ব পাশে বাইরে পড়ে আছে ময়লার স্তুপ, প্রতিদিনই এখানে ময়লা স্তুপ করে রাখা হয়।
এ বিষয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী শামসুল হক শাফিম বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ভবন এরকম হতে পারে না। অগোছালো, অপরিস্কার এবং কোন কোন স্থানে ময়লা পড়ে আছে। অব্যবহার্য জিনিস যথেচ্ছভাবে রাখা আছে। মূল্যবান জিনিসগুলো বাইরে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। এভাবে ফেলে না রেখে কতৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে।'
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাতুন নাহার বলেন, 'প্রশাসনিক ভবনের কিছু কিছু অংশ খুবই স্যাঁতস্যাঁতে। ভেতরে হাঁটলে দূর থেকে টয়লেটের অবস্থান টের পাওয়া যায়। ভেতরে অনেক পুরনো জিনিসপত্রে বালু জমে আছে। এসব পরিবেশ নষ্ট করে।'
ময়লার বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত এস্টেট ম্যানেজার ফাতেমা বিনতে মুস্তাফা বলেন, 'রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের সামনের ময়লাগুলোসহ আমাদের ডাস্টবিনের ময়লাগুলো সিটি কর্পোরেশন প্রতি দুইদিন পর পর এসে নিয়ে যায়। এছাড়া, প্রশাসনিক ভবনের উত্তর পশ্চিম কোণায় যে ইলেকট্রনিক স্ক্র্যাপসহ ভাঙ্গা জিনিসপত্র আছে, সেগুলো সরানোর জন্য আমরা প্রকৌশল দপ্তরকে বারবার নোটিশ দিয়েছি। তারা কেন এখনো এগুলো সরায়নি, বলতে পারছি না।'
এদিকে প্রশাসনিক ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম অংশে পড়ে আছে পরিত্যক্ত যানবাহন। সাধারণত প্রতি দুই বছর অন্তর নিলাম হওয়ার কথা থাকলেও গত চারবছরে কোন নিলাম হয়নি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রশাসনিক ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম পাশ মিলিয়ে সর্বমোট ৯ টি বাস ও মিনি বাস, একটি প্রাইভেটকার, একটি মিনি কার ও একটি কাভার্ড ভ্যান পড়ে আছে। এগুলোর কোনটিই রাস্তায় চলার উপযোগী নয়।
এ বিষয়ে পরিবহন ম্যানেজার কামরুল হাসান বলেন, 'সাধারণত আমরা প্রতি দুই বছর পর একটি নিলাম ডাকার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেকসময় উল্লেখযোগ্য পুরনো গাড়ি যুক্ত না হলে আমরা নিলাম ডাকতে পারি না। শীঘ্রই একটি নিলাম আয়োজন করার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে পড়ে থাকা গাড়ির বাইরেও আমাদের পুরাতন কিছু গাড়ি রয়েছে। সাধারণত ২০ বছরের বেশি সময়ের গাড়িগুলো ট্রাফিক আইনে ফিটনেস অনুমোদন দেয় না। আমাদের অনেক গাড়ি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো থাকায় ২৭ বছর ধরেও চলছে। আমরা কতৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই সেগুলো চালাচ্ছি।’
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, 'আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু অনেক পুরনো, আগে থেকে পরিকল্পনা না নেওয়ায় এ সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। মাস্টারপ্ল্যানের মধ্যে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তা হওয়ার আগ পর্যন্ত এসব সমস্যার সমাধান হওয়ার সুযোগ নেই। এখানের কর্মপরিবেশ এখন কোনভাবেই অনুকূল নয়। আমরা চাইলে কোন ডকুমেন্ট (নথি) ফেলেও দিতে পারি না, কখন লেগে বসে।'
সামনে ডিজিটাল আর্কাইভের কোন পরিকল্পনা আছে কি না প্রশ্নে উপাচার্য বলেন, 'সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে তবে এর জন্য বড় একটি প্রজেক্ট লাগবে। ১০০ বছরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র আর্কাইভ কর স্বতন্ত্র্য একটি প্রজেক্টের প্রয়োজন। বর্তমানে গ্রন্থাগারের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রগুলো ডিজিটালাইজেশনের কাজ চলছে।'
এসজে/আরইউ