চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি : কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ৭০ বছরের পুরানো ৩১ শতক সম্পত্তি নিয়ে মসজিদ কমিটি ও ভোগদখলকারীদের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। ২০ বছর আগে সমপরিমান জায়গা এওয়াজ পাল্টা বিনিময় হলেও মসজিদ কমিটির দায়িত্বরত ব্যক্তিরা ‘সম্মান’ টিকিয়ে রাখতে সেটি পুনরায় উদ্ধারের চেষ্টা করছে। ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার ১৩নং জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। মসজিদ কমিটি সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য আদালতে মামলাও করেছে। হাইকোর্টের রায়ের পর উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছে ৮ পরিবারের শিশু, নারী ও পুরুষ। সর্বশেষ সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগ রোববার(১৫ অক্টোবর) মামলাটি শুনানির জন্য ধার্য করেছে।
জানা যায়, ২০০২ সালে সোনাপুর গ্রামের আশরাফ আলী চৌধুরী ওয়াকফ্ এস্টেটের সোনাপুর জামে মসজিদ কমিটির সহ-সভাপতি চৌধুরী মমিনুল ইসলাম ওয়াকফ্ এস্টেটের জায়গা উদ্ধারে আবদুল গফুর গংয়ের বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে মামলা করেন। ২০০৩ সালের ১৬-১৯ মার্চ সমন্বয় দলিল মসজিদ কমিটির সাথে তাদের পছন্দ অনুযায়ী সাব কবলায় নোয়াগ্রাম মৌজায় ৩১ শতক সম্পত্তির বিনিময় ৪টি দলিল রেজিষ্ট্রি হয়। বর্তমানে মসজিদের পশ্চিম পাশে ওই ৩১ শতক জায়গা আবাদযোগ্য জমি হিসেবে রয়েছে। সম্পত্তির বিরোধ নিয়ে কুমিল্লার বিজ্ঞ ৩নং আমলী আদালতে ছোলেমূলে মোকদ্দমা নিস্পত্তি হয় ২০০৩ সালের ২৩ এপ্রিল।
এতে দেখা যায়, মসজিদ কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত চৌধুরী মমিনুল ইসলামসহ কমিটি ও বর্তমানে ভোগ দখলে অবস্থিত উভয়পক্ষ মেনে নেয় ও স্বাক্ষর করেন। একই বছরের ১৭ মে ১ম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট উভয়পক্ষের আপোষ নিস্পত্তি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মামলায় নথিভুক্ত করেন। তখন ওয়াকফ্ এস্টেটের সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁর কার্যালয় থেকে ওয়াকফ্ প্রশাসকের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেয়। দীর্ঘ ১১ বছরেও বিনিময় দলিলগুলো ওয়াকফ্ প্রশাসন কর্তৃক অনুমোদন না দেয়ায় আইনগত জটিলতা থাকায় ২০১৪ সালের ২৪ জুন মসজিদ কমিটিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৬ সেপ্টেম্বর মসজিদ কমিটির পক্ষে সভাপতি আবদুর রহিম চৌধুরী ওয়াকফ্ প্রশাসনে একটি আবেদন দাখিল করেন। ওয়াকফ্ প্রশাসনের নিরীক্ষক সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখতে পায়, আবদুল গফুর গং দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে দালান ঘর নির্মাণ করে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে এবং তাদের নামে আরএস ও বিএস খতিয়ান রয়েছে। সোনাপুর মৌজার নালিশী সম্পত্তির ২০১৮ সালের ৫ জুন বিএস খতিয়ান প্রকাশিত হয়। কোন প্রকার আপত্তি না থাকায় উভয়পক্ষের কেউ খতিয়ান সমূহের বিরুদ্ধে ভুমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে আদালতে কোন মামলা নেই।
এদিকে ২০১৬ সালে চৌধুরী মমিনুল ইসলাম এওয়াজ পাল্টাকৃত সম্পত্তি উদ্ধারে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে পিটিশন(৬৬৩১) দাখিল করেন। হাইকোর্ট ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট চৌধুরী মমিনুল ইসলাম গংয়ের পক্ষে রায়। স্থিতিবস্থা রাখার জন্য আবদুল গফুর গং ২০২২ সালে আপিল পিটিশন(২৩২৬) দাখিল করে। চৌধুরী মমিনুল ইসলাম গংয়ের পক্ষে মসজিদ কমিটির বর্তমান মোতয়াল্লী জাহিদুল ইসলাম চৌধুরী রায় বহাল রাখার জন্য আবেদন করেন। হাইকোর্ট উভয় পক্ষের আবেদন ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করেন। নির্দিষ্ট দিনে শুনানি না হওয়ায় হাইকোর্টে মসজিদ কমিটির পক্ষে রায় বহাল থাকে। এরই মধ্যে ২ অক্টোবরের ইস্যুকৃত আদেশ গত ৯ অক্টোবর উপজেলা সহকারী কমিশনার ভুমির কার্যালয় থেকে ১৮ অক্টোবর আবদুল গফুর গং ৩১ শতক জায়গা মসজিদ কমিটিকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য নোটিশ প্রদান করে। গত ৩ অক্টোবর আবদুল গফুর গংয়ের পক্ষে মোঃ আবদুল্লাহ স্থগিতাদেশের জন্য সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগে দাখিলকৃত লীভ পিটিশনটি ১৫ অক্টোবর রোববার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের আদালতে শুনানির জন্য ধার্য করেন। অপরদিকে মসজিদ কমিটির পক্ষে হাইকোর্টেও রায়ের পর উচ্ছেদ আতঙ্কে কান্নাকাটি করছেন নারী-শিশুসহ ৮ পরিবারের সদস্যরা।
কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ১৯৫৬ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে সম্পাদিত আরএস খতিয়ান নং-১৯ জেএল নং-১৯৪ মতে আবদুল গফুর গং ২৪০, ২৪১ ও ২৪২ দাগে মোট ৩১ শতক ভুমির মালিক হন। এছাড়া বিএস খতিয়ান নং-৬০,২০১ ও ২৫৬ মতে নতুন দাগ ৩৫৬। এতে আবদুল গফুর, ছেরাজুল হক, নুরুল ইসলাম গং দীর্ঘদিন ধরে চারদিকে সীমানা প্রাচীরসহ পাকাদালান বিশিষ্ট ঘর নির্মান করে বসবাস করছে। আবদুল গফুর গং বসবাসকৃত জায়গার নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করে আসছে।
২০১৩ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারি প্রকাশিত ওয়াকফ্ সম্পত্তি হস্তান্তর আইন পর্যালোচনা করে জানা গেছে, বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যা কর্তৃপক্ষ প্রকাশিত ওয়াকফ্ সম্পত্তির হস্তান্তর ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কল্পে বিশেষ বিধান করিবার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ৫নং আইন প্রণীত হয়। এতে ৪নং ধারায় হস্তান্তর পদ্ধতি(১) উপধারায়(ঘ)-তে বলা হয়, বিনিময়ের মাধ্যমে ওয়াকফ্ সম্পত্তি হস্তান্তর করা যাইবে। যা উল্লেখিত সম্পত্তিতে এওয়াজ পাল্টা করে মসজিদ কমিটি থেকে আবদুল গফুর গং ভোগ করবে।
সাবেক মেম্বার কুতুব উদ্দিন, বেলাল হোসেন, সোনাপুর গ্রামের আলী আকবর চৌধুরী বলেন, ‘আবদুল গফুর গংয়ের সাথে মসজিদ কমিটির ৩১ শতক সম্পত্তি এওয়াজ পাল্টা হয়েছে। এটা সবাই জানে। হাইকোর্ট মানবিক দিক বিবেচনা করে আবদুল গফুর গং যে অবস্থানে আছে, সে অবস্থানে থাকার অনুমতি দিলে সামাজিকভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে’।
এদিকে সোনাপুর জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোতয়াল্লী জাহিদ চৌধুরী আদালতের আদেশের বাইরে কোন কথা বলতে রাজি নয়।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) তমালিকা পাল বলেন, ‘হাইকোর্ট বিবাদমান ৩১ শতক সম্পত্তি মসজিদ কমিটিকে বুঝিয়ে দেয়ার আদেশ দিয়েছে। এরই মধ্যে আবদুল গফুর গং হাইকোর্টে আপিল ডিভিশনে একটি পিটিশন দাখিল করলে আদালত ১৫ অক্টোবর শুনানির জন্য ধার্য করে। আমরা হাইকোর্টের সর্বশেষ আদেশ পালন করতে প্রস্তুতি রয়েছি’।
এসজে/আরইউ