সময় জার্নাল ডেস্ক:
১৪ অক্টোবর ১৯৫৪, সন্ধ্যে হয় হয়। ধর্মতলা থেকে বালিগঞ্জের দিকে ২৪ নম্বর রুটের BOG 304 ট্রামটি দুদিক-রাস্তার মাঝখানের ঘাসের ওপরের ট্রাম লাইন বেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। ছেলে রঞ্জুর জন্য দু'হাতে দু'টি ডাব নিয়ে লেক মার্কেট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন জীবনানন্দ দাশ। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলেন অথবা ঠাহর করতে পারেননি ট্রামের গতি। তাছাড়া ডায়াবেটিসের জন্য গত কয়েকবছর ধরে দৃষ্টিশক্তিও ঝাপসা হয়ে এসেছিল। ট্রাম কিন্তু অবিরাম ঘণ্টা বাজাচ্ছিল, সতর্কবাণী উচ্চারণ করছিল ট্রামের ড্রাইভার, চারপাশের লোকজন চিৎকার করে উঠেছিল। কিন্তু যা অনিবার্য তাই ঘটে গেল। কবি ট্রামের সামনে পড়ে গেলেন, ইঞ্জিনের সামনের কাউ-ক্যাচার টেনে নিয়ে গেল তাকে। একসময় ট্রাম থেমে গেল কিন্তু ততক্ষণে ট্রামের নীচে চাপা পড়ে গুরুতর আহত হলেন কবি। যে অবহেলা আজীবন তাঁকে ঘিরে ছিল, আহত হয়েও তার থেকে মুক্তি পেলান না, পরেরদিন একটি দৈনিক পত্রিকায় লেখা হল, 'ট্রাম হইতে পতনের ফলে গুরুতর আহত' হন কবি!
চারপাশের লোকজন দৌড়ে এল। সাদার্ন ফার্মেসির ঠিক উল্টো ফুটপাতে চুনিলালবাবুর জলখাবারের দোকান। চুনিলাল দে---বজরঙ ব্যায়ামাগারের ট্রেনার, কুস্তিগীর, বেশ স্বাস্থ্যবান, দোহারা চেহারা। পুলিশের ভয়ে কেউ না ধরলেও চুনিলাল এগিয়ে এলেন। পাঁজাকোলে কবিকে তুলে নিলেন। তারপর কোনওমতে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে সোজা শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল।এই গ্রহের এক মন্থর যানে আহত হয়ে ২২ অক্টোবর মৃত্যু হল জীবনানন্দ দাশের।
কবি কি আন্দাজ করেছিলেন তাঁর এই সম্ভাব্য দুর্ঘটনার কথা? নয়তো ১১ ও ১২ অক্টোবর ১৯৫৪, পরপর দুদিনই জীবনানন্দ দাশ তাঁর ছোটোভাই অশোকানন্দ দাশের বাড়ি গিয়ে কেন জানতে চাইছেন দেশপ্রিয় পার্কের কাছে গাড়ি দুর্ঘটনায় কেউ আহত হয়েছে কিনা! যা ঘটল-ই না তার কথা আগাম কীভাবে শুনলেন কবি?
এত সাবধানী জীবনানন্দ যে রাস্তা পেরোতে দূরে গাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে পড়তেন। বাসে ড্রাইভারের বিপরীত দিকের সিটে বসতেন যাতে অ্যাক্সিডেন্ট হলে তাঁর আহত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। হাঁটতেন ফুটপাত ধরে। সেদিন তবে কী এমন ঘটেছিল যে পৃথিবীর এক ধীরগতি যান এসে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল!
আসলে ট্রাম নিয়ে একধরনের 'অবশেসন' ছিল জীবনানন্দ দাশের। নয়তো ১৯৩২-এর ডায়েরিতে কীভাবে লেখেন: 'How quite possible it may be to slip and runvover by 'tram'…'। অথবা ১৯৩৩-এর এক গল্পে একটি চরিত্র অন্য একটি চরিত্রকে, তার বাড়ি ফেরার সময়, সাবধান করে, ট্রামে যেন চাপা না পড়ে। হ্যাঁ, বাস বা গাড়ির কথা উল্লেখ করেননি জীবনানন্দ, যা স্বাভাবিক ছিল, করেছেন ট্রামের কথা। এরপর ট্রাম নিয়ে তাঁর সেই অমোঘ উক্তি, ট্রামকে বলছেন, 'philosopher's car'! অনেক কারণ থাকতে পারে এই উক্তির নেপথ্যে, কিন্তু আমার মনে হয় প্রধান একটি ভাবনা কাজ করেছে জীবনানন্দর মনে, ট্রামের সঙ্গে যে মন্থরতা ও বোরডোম জড়িয়ে আছে --- জীবনানন্দ নিজেও তার আজীবন সাধনা করে গেছেন। কবিতায় তাই লিখবেন:
'আমি অত তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক: আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নীচে।'
কত কবিতায় ঘুরে ঘুরে যে ট্রামের কথা এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। লিখেছেন, 'ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি: এখন গভীর রাত/ কবেকার কোন্ সে জীবন যেন টিটকারি দিয়ে যায়/ 'তুমি যেন রড ভাঙা ট্রাম এক— ডিপো নাই, মজুরির প্রয়োজন নাই/ কখন এমন হয়ে হায়!'/ আকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে/ কবেকার কোন্ সে জীবন ডুবে যায়।' অথবা, 'শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন/ জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ;' কিংবা, 'কয়েরটি আদিম সর্পিণী সহেদরার মতো এই-যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে/ পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ অনুভব ক'রে হাঁটছি আমি।'
এমনকি মৃত্যুর ক'দিন আগে, হাসপাতালের বেডে শুয়ে সহকর্মী বন্ধু অজিত ঘোষকে যা বলেছিলেন তাতেও 'ট্রাম'-এর কথা:
'ভেবেছিলাম ট্রামটা জলখাবারের সামনের স্টপেজে দাঁড়াবে। আমি ইতিমধ্যে পার হয়ে যাব। কিন্তু তা আর হ'ল না। মরেই যেতাম কিন্তু কেন যেন বেঁচে উঠলাম। জানি না কতদিন শুয়ে থাকতে হবে।'
যাঁরা জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হত্যা, আত্মহত্যা না দুর্ঘটনা তা নিয়ে নানান জল্পনাকল্পনা করেন, তাঁদের প্রতি যেন কবির জবাবও এটি।
আর নিয়তির কী অদ্ভুত পরিহাস। যে ট্রামের আঘাত জীবনানন্দকে মৃত্যুর পথে টেনে নিয়ে যাবে, ঠিক একবছর আগে ১৯৫৩-এ, সেই ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সংঘটিত ব্যাপক আন্দোলনে জীবনানন্দ সামিল হয়েছিলেন। ব্রিটিশ কোম্পানির মালিকানাধীন কলকাতা ট্রাম কোম্পানি দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাড়া বৃদ্ধি করেছিল ১ পয়সা, বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, ১ জুলাই ১৯৫৩ থেকে এই ভাড়া বৃদ্ধি হবে। গড়ে তোলা হয় 'প্রতিরোধ কমিটি'। যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন সিপিআই নেতা জ্যোতি বসু ও ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসু। আন্দোলনের স্বপক্ষে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে জীবনানন্দ ছিলেন ১৭ নম্বরে।
আমি সেই ট্রাম ড্রাইভারকে খুঁজি। শুনেছি চেতলা অঞ্চলে বাড়ি ছিল তাঁর। ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ বাড়ি ফিরে নিশ্চয় কষ্ট হয়েছিল। এতবার ট্রামের ঘণ্টা বাজাচ্ছিলেন, রাস্তার লোকজন তারস্বরে চিৎকার করছিল, তবু মানুষটির যেন কোনও বাহ্যজ্ঞান ছিল না। আপনমনে রাস্তা পার হচ্ছিলেন।এই পৃথিবীর হয়েও যেন এই পৃথিবীর নয়। পরেরদিন কবির দুর্ঘটনার খবর 'যুগান্তর' পত্রিকায় প্রকাশিত হল।ট্রাম ড্রাইভার ভদ্রলোকের তা নজর এড়িয়ে গেল। আর অন্যদিনের মতো তিনি ঘর থেকে বের হলেন, কাজে গেলেন।শুধু দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলের কাছাকাছি এলেই বুকে যেন চিনচিন ব্যথা। ইস্, ভদ্রলোককে বাঁচাতে পারলাম না! শুধু তাঁর নিজের জীবনে কেন, কারও কাছেই তিনি শোনেননি, কোনও মানুষ ট্রামে চাপা পড়েছে।
আমি সেই ট্রামটিকে খুঁজি, শুনেছি সেই অভিশপ্ত ট্রাম আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। আমি দু'দিক রাস্তার মাঝখানের সেই ঘাস খুঁজি, ঘাসে কবির রক্তের দাগ খুঁজি, কতদিন হল, সেই ঘাস উপড়িয়ে ফেলে কংক্রিট করে ফেলা হয়েছে।
মৃত্যু নিয়ে একটু বেশিই আবিষ্ট ছিলেন ট্রামে চাপা পড়া মানুষটি। তাঁর গল্পের নায়ক মৃত্যু নদীর কোনও এক রাজহংসীর জন্য শুধু অপেক্ষা করে।তাঁর গল্পের নায়ক একখানা স্টিক হাতে নিয়ে অন্ধকারে বাড়ি থেকে বের হয়, 'জীবনের যত মৃত ধ্বনি, যত মৃত কথা, মৃত সুখ খুঁজে বার করবার জন্য'।
কী আশ্চর্য সমাপতন! সেই ট্রাম ড্রাইভারের ১৬/১৭ বছরের ছেলেটি বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা পড়ত। এবং জীবনানন্দ দাশের কবিতা। লুকিয়ে কারণ বাবা ছেলেকে কবিতা পড়তে দেখলে খুব রেগে যেতেন যে। ততদিনে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হয়েছে, ট্রাম ড্রাইভার জানতে পেরেছেন, যেমন তেমন মানুষ নন তিনি, এই সময়ের একজন মহত্তম কবি।
সেদিন একটু আগেই বাড়ি ফিরে এসেছেন। মনটা ভালো নেই।শুধু সেই কবির মুখটা চোখে ভাসছে। শেষ মুহূর্তে হাজার চেষ্টা করেও দুর্ঘটনা রোধ করতে পারেননি তিনি। ছেলেকে কোমল গলায় ডাকলেন, কী কবিতা পড়িস তুই আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে! ছেলে কম্পিত হাতে একটি কবিতার বই বাবার সামনে মেলে ধরল। জীবনানন্দ দাশ প্রণীত শ্রেষ্ঠ কবিতা। বাবার চোখে জল। আলতো হাতে ছেলেকে স্পর্শ করলেন। যেন অতীত ভবিষ্যতকে স্পর্শ করছে। তখন অনেক রাত। চেতলা থেকে ক্যাওড়াতলা শ্মশান তো বেশি দূরের পথ নয়। কিছুদিন আগে জীবনানন্দকে এখানে দাহ করা হয়েছে। ছেলে সঙ্গে কবির বই নিয়ে এসেছে। বাবা অস্ফুট স্বরে বললে, বাছা কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনা তো। শ্মশানের নিভন্ত আলোতে ছেলে পড়তে থাকে:
'তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই— তবু,
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই— তুমি
আজো এই পৃথিবীতে র'য়ে গেছ।
কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ;
বহুদিন থেকে শান্তি নেই।
নীড় নেই
পাখিরো মতন কোনো হৃদয়ের তরে।
পাখি নেই।
মানুষের হৃদয়কে না জাগালে তাকে
ভোর, পাখি, অথবা বসন্তকাল ব'লে
আজ তার মানবকে কি ক'রে চেনাতে পারে কেউ।'
[আজ ২২ অক্টোবর জীবনাননন্দ দাশের ৬৯তম প্রয়াণবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারী বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি]