মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : মাত্র এক বছর আগে ঘটে যাওয়া আম্পানের ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আবারও শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর সম্ভাব্য আঘাত হানার খবরে সাতক্ষীরার গোটা উপকূলজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি। বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জীর্ণশীর্ণ বেড়ি বাঁধ উপকূলবাসীকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। আম্পানের আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বাড়িঘর প্লাবিত হয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিধ্বস্থ সেই ঘরবাড়ি এখনও পরিপূর্ণভাবে মেরামত করতে না পারায় চরম উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছেন তারা।
স্থানীয়রা জানায় ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ও আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া সাতক্ষীরার উপকূল রক্ষা পাউবো’র বেড়ি বাঁধের বেশিরভাগ অংশ এখনো টেকসইভাবে বাঁধা হয়নি। অনেক এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ যেমন ঠিকমত মেরামত করা হয়নি, তেমনি গোটা উপকূলজুড়ে বাঁধের উপরিভাগে আজ পর্যন্ত কোন মাটির কাজ হয়নি। এমতাবস্থায় ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ বা ‘যস’ যদি সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদে আঘাত হানে তাহলে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ফের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শংকা রয়েছে। এছাড়া ভরা পূর্ণিমার কারণে একই সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় নদ-নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধির আশঙ্কায় চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন সাতক্ষীরার উপকুলীয় এলাকায় বসবাসকারিরা।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া গ্রামের মাস্টার শফি জানায়, আম্পানের পর এক বছর কেটে গেলেও প্রতাপনগরকে ঘিরে থাকা বাঁধের উপর মাটি দিয়ে উঁচু করার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ভাঙ্গনমুখে থাকা অনেক জায়গার বাঁধ এখনও সরু আইলে পরিণত হয়েই আছে। এমন অবস্থায় পূর্ণিমার ভরা গোনে যদি ঘূর্ণিঝড় ‘যস’ আছড়ে পড়ে তবে আমাদের নদীতে ভেসে যেতে হবে। আম্পানের পর দীর্ঘ সময় আমার বাড়িতে উঠতে পারিনি। এখনো পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ঘর ঠিকমত গুছিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। এরইমধ্যে নতুন করে যদি ঘূর্ণিঝড় অঘাত আনে তাহলে আমাদের এলাকা ত্যাগ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের মুর্শিদা খাতুন বলেন, মাত্র দশ দিন আগে স্বামীকে বাঘে খেয়েছে। ছেলে মেয়েদের মুখে খাবার দিতে পারছি না। এই দুঃসময়ে কোন জাগায় আশ্রয় নেবো ভেবে পাচ্ছিনে। ঝড়ের আগেই প্রতিবেশীদের সাথে মিলে চার সন্তান ও বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাবেন বলেও জানান সদ্য বিধবা এ নারী।
তবে এমন শংকায় ভরা অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি কেবলই মাস্টার শফি বা মুর্শিদা খাতুনের কন্ঠে না। বরং আশাশুনির প্রতাপনগর, আনুলিয়া ও শ্রীউলা ইউনিয়ন এবং শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ, বুড়িগোয়ালীনি ও কৈখালী ইউনিয়নসহ উপকূলীয় জনপদে বসবাসরত হাজারও মানুষের মধ্যে কাজ করছে যশ আতংকের অভিন্ন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
তারা জানায়, বেড়িবাঁধের দুরাবস্থা আর কর্মসংস্থানসহ পানীয় জলের তীব্র অভাবে প্রতিনিয়ত তারা জীবনের সাথে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। প্রকৃতির হুমকিতে বার বার বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়া ও ফিরে আসার এমন টানা হেঁচড়ার মধ্যে ভাঙ্গন কবলিত বাঁধ তাদের দুর্দশায় অন্যতম প্রধান কারণ। আশ্রয় কেন্দ্র যেয়ে নিজেদের জীবন বাঁচানোর সুযোগ থাকলেও বাড়ি ঘর আর গৃহস্থলীর জিনিপত্রের সাথে সাথে পোষ্য গবাদী পশু-পাখি নিয়েও তারা চিন্তিত রয়েছেন।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদল আলম জানান, তার ইউনিয় চারিদিক থেকে কপাতাক্ষ নদ ও রবিবার থেকে পূর্নিমার গোণ শুরু হয়েছে। ‘যস’ এর সাম্ভব্য আঘাতের সময় ২৬ মে হলে তখন ভরা পূর্নীমায় নদীতে জোয়ারের পানি মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ওই মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে গোটা উপকূল সাগরের সাথে একাকার হয়ে যাবে। আগেই বাড়িঘর ছেড়ে যেয়ে নিজেদের হয়ত বাঁচানো যাবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ফের ঘূর্ণিঝড়ের আশংকায় বসতবাড়িসহ এতবছর ধরে গড়ে তোলা সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার শংকায় রয়েছে পুরো ইউনিয়নবাসি।
আশাশুনির প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, পূর্বে কপোতাক্ষ নদ ও পশ্চিমে খোলপেটুয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত তার ইউনিয়ন। তিনদিক দিয়ে রয়েছে পাউবো’র বেড়িবাঁধ। এসব বেড়িবাঁধের অধিকাংশ স্থানের অবস্থাও খুবই নাজুক। ঘূণিঝড় আম্পানের অঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল প্রতাপনগর ইউনিয়ন। ইউনিয়নের ৪০ কিলোমিটার বাঁধের সব নষ্ট হয়ে যায়। আম্পানে খোলপেটুয়া নদীর চাকলা, দিঘলারআইট, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ারবিল, কুড়িকাহুনিয়া, হরিষখালি, হিজলিয়া কোলাসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়ে।
তিনি আরো বলেন, পাউবোর বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন পয়েন্ট মেরামতের পর ইউনিয়ের আভ্যন্তরীণ সড়কগুলো মেরামত করে সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এই অবস্থায় ঘূর্ণিঝড় ‘যস’ এর আঘাতের আগাম খবরে গোটা ইউনিয়নে এক ভয়ার্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফের বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হওয়ায় আশংকা আতংকিত এলাকার মানুষ। সবাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পুর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে অধিক জোয়ারের চাপে বাঁধ ভেঙ্গে বা ছাপিয়ে নদীর পানিতে সমগ্র এলাকা প্লাবিত হওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশী শংকায় রয়েছেন ইউনিয়নবাসি।
জেলা পরিষদের সদস্য আনুলিয়ার বিছট গ্রামের আব্দুল হাকিম মোড়ল বলেন, আম্পানের আঘাতে বিছট গ্রামের ৪টি পয়েন্টে বেড়িাঁধ ভেঙ্গে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। পাউবো কর্তৃপক্ষ এসব বাঁধ সংস্কার করলেও উচ্চতা কম হওয়ায় জোয়ার বৃ চাপিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। ঘূর্নিঝড় যশ’র প্রভাবে নদীতে জোয়ার বৃদ্ধি পেলে বাঁধ ছাপিয়ে যাওয়ার আশংকায় কর্মসৃজনের শ্রমিক দিয়ে বাঁধের রিভার সাইডে সামান্য উচু করে মাটি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু জোয়ার বেশি বৃদ্ধি পেলে তাও টিকে থাকবে বলে মানে হয় না। ফলে আবারও প্লাবনের আশংকায় রয়েছে গ্রামবাসি।
নাগরিক নেতা অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম বলেন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এলেই অনেক কথা হয়। কিন্তু তৎপরবর্তী পর্যায়ে ঝুঁকির মধ্যে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষার বিষয়ে কার্যত কোন দৃঢ় পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুর্যোগের সময়ে তার বার বার উদ্বাস্তু হওয়ার শংকার মধ্যে পড়ে। উপকূলীয় এলাকায় টেসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় প্রতিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধ ভেঙ্গে মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, আম্পানের আঘাতের পর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা প্রায় ১৮০ কিলোমটিার বাঁধ এর কোথাও আপাতত নদী ভাঙ্গনের সমস্যা নেই। তবে অতিরিক্ত জোয়ারের পানি যেন ছাপিয়ে বাঁধের ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য একাধিক টিম দুর্বলতা খুঁজে বের করে সমাধানে কাজ করছে। আশা করা যাচ্ছে ২৫ মে এর আগেই গোটা শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা বাঁধের দুর্বল স্থানে কাজ সম্পন্ন করে সাম্ভব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দেয়া যাবে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম বাপ্পি জানান, তার বিভাগের আওতাধীন ৭/২ পোল্ডারসহ কয়েকটি পোল্ডারে কমপক্ষে ১৬টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ এখনো ঝুকিপূর্ন রয়েছে। বাকি প্রায় সব জায়গায় আমরা মেরামতের কাজ করেছি। ঘূর্নিঝড় যশ আম্পান বা আইলার মত যদি শক্তিশালী না হয় তাহলে অসুবিধা হবে না। এরপরও ঝুকিপূর্ণ পয়েন্ট গুলোতে যাতে নদীর পানি বেড়িবাঁধ ওভার ফ্লো না করে সেজন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমি নিজেসহ আমার অফিসের এসও এবং এসডিসহ সকলেই উপকূলীয় এলাকায় অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করছি।
উল্লেখ্য, বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে আগামী ২৫ তারিখ সন্ধ্যার দিকে ভারত-বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা অতিক্রমের বার্তা দিচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে উপকূলীয় জনপদে কর্মরত পাউবো, বিদ্যুৎ ও সিপিপি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবায় যুক্ত সকলকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকতে বলা হয়েছে।
সময় জার্নাল/এসএ