মাইদুল ইসলাম:
শীতলক্ষ্যার কোল ঘেষেঁ বয়ে চলা রাস্তার মুরাপাড়া এলাকা দিয়ে চলার সময় সৌন্দর্য্য পিয়াসীর নজর কাড়ে শত বছরের বেশি পুরোনো একটি ভবন। নান্দনিক কারুকাজের ভবনটিতে রযেছে ৯৫টি কক্ষ। প্রাচীন জমিদারদের রাজকার্যসহ বিভিন্ন কাজে এসব কক্ষ ব্যবহার করা হতো। যেখানে এক সময়ে জমিদারদের আইন পাশ হত, যেখানে বসে এ দেশের মানুষের উপর কর ধার্য করা হত সেখানেই কালের বিবর্তনে হচ্ছে বিদ্যাচর্চা-পড়ালেখা, ছড়াচ্ছে শিক্ষার আলো । ঘোড়ার পায়ের ঠক ঠক শব্দ, হাতির পিঠে চড়ে জমিদারদের ভ্রমণ, পাইক পেয়াদার পদ চারণায় মুখরিত ছিল যে বাড়িটি সেখানে এখন হাজারো শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত থাকে। কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ-শ্যামল মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি। যা বর্তমানে মুড়াপাড়া সরকারি কলেজ। মনোমুগ্ধকর এ জমিদার বাড়িটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন আসে শতশত পর্যটকও।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৫২ বিঘা জমির ওপর এই জমিদারবাড়ি। ১৯৪৭ সালে জমিদার সপরিবার কলকাতা চলে যান। পরে সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে নেয়। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন সরকার এখানে এবি হাসপাতাল স্থাপন করে। এরপর এটিকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। ১৯৬৬ সালে জমিদার বাড়ির এক পাশে মুড়াপাড়া পাইলট হাইস্কুল এবং স্কুলের দোতলা ভবনে হাজী গোল বকস ভূঁইয়া কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালে কলেজটির নামকরণ করা হয় মুড়াপাড়া কলেজ। পাশাপাশি কলেজটিকে জমিদারবাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। ওই সময় উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও কলা বিভাগ চালু হয়। ডিগ্রি পর্যায়ে ছিল কলা ও বাণিজ্য বিভাগ।
কাঞ্চন ব্রীজ এলাকার শিমুলিয়া বাজার ঘাট থেকে ঢাকা ডিনার ক্রুজে শীতলক্ষ্যার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে মুরাপাড়ায় পৌঁছালাম ততক্ষণে সকাল গড়িয়ে বেলা দ্বিপ্রহর। জমিদার বাড়ির সামনে শীপ থামলো। তীরে নেমে রাস্তা পেরোতেই দেখা মিলল প্রকন্ড জমিদার বাড়ির। বাউন্ডারি পেরিয়ে জমিদার বাড়ির সীমানায় ঢোকার মুখে পাশে রয়েছে ঘাট বাঁধানো মস্ত পুকুর। ঘাটে বসে পা ভিজিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন পর্যটকেরা, কেউ কেউ আবার নেমে পড়েছেন গোসল করতে। এরপরেই রয়েছে মাঠ। মাঠ পেরোতেই জমিদার বাড়ির মূল ভবনটি। এই ভবনটিতে দেখা মেলে প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন। ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পাই চলছে নাটকের শ্যুটিং। তবে কলেজ বন্ধের দিন হওয়ায় দুইতলায় দেখা যায়নি। ভবনটিতে দেখা মিলে উল্লাসের জন্য ছিল নাচঘর, পূজা-অর্চনার জন্য মন্দির, রাজকার্য পরিচালনার জন্য রাজকক্ষ, অতিথিশালা, কাচারি ঘর, বৈঠকখানা ইত্যাদি।
উত্তর-দক্ষিণে লম্বা দুই তলা একটি দালানকে কেন্দ্র করে বিশাল আয়তনের এই বাড়ি। হাতের বামে দুটি মন্দির। তার পেছনেই বিশাল আম বাগান। প্রান্তর পেরিয়ে গেলে বাঁধানো চারটি ঘাট বিশিষ্ট একটি পুকুর। যেখানে রয়েছে মেয়েদের গোসলেন জন্য শানবাঁধা ঘাট। কার্তিকের মিষ্টি হাওয়ার দুপুরে গিয়ে দেখি পেছনের পুকুরটি রয়েছে শুধুই নিরবতা। পুকুরের পাশে উঁচু পুরু দেয়ালে ঘেরা।
পেছেনে বাঁধানো চারটি ঘাট বিশিষ্ট পুকুর; ছবি: মাইদুল ইসলাম
পুকুরের সামনেই খোলা সবুজ মাঠ। মাঠে আম বাগান ও সারি সারি গাছ। জনশ্রুতি আছে গাছগুলো শতবর্ষী। বাড়ির মূল ভবনের পেছনে পাকা মেঝের একটি উঠান। উঠানটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর চারপাশ দ্বিতল দালান বেষ্টিত। উত্তর পাশেরটি অন্দর মহলের মন্দির। ভবনের এই অংশের পেছনেও আছে আরেকটি দালান। এদিকে বাড়িটির সামনে পেছনে ঘাট বাঁধানো পুকুর জমিদার বাড়ির পরিবেশকে করেছে আরও সুন্দর।
পেছনেও আছে আরেকটি দালান; ছবি: মাইদুল ইসলাম
জানা যায়, ১৮৮৯ সালে রামরতন ব্যানার্জী এখানে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। রামরতন ব্যানার্জী এর কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। ১৯০৯ সালে কাজ শেষ করেন তার নাতি জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী।
বর্তমানে মুড়াপাড়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও কলা বিভাগ, ডিগ্রি পর্যায়ে বিএসসি, বিএ, বিএসএস, বিবিএস; অনার্স পর্যায়ে হিসাববিজ্ঞান, মার্কেটিং, ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মাস্টার্স পর্যায়ে অ্যাকাউন্টিং কোর্স চালু আছে।
কালের বিবর্তনে জমিদার বাড়িটি আজ শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পর্যটক ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে।
এখানে যেভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ, গুলিস্তান অথবা যাত্রাবাড়ী থেকে মেঘলা, গ্লোরী, আসিয়ান পরিবহন অথবা নরসিংদী ভৈরবগামী যেকোন বাসে রূপসী বাসস্ট্যান্ড অথবা ভুলতা নামতে হবে। তারপর রিকশাযোগে জমিদার বাড়ি। রূপসী বাসস্টেশন থেকে সিএনজি করে মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি যাওয়া যায়। এছাড়া ডেমরাঘাট হয়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে মাঝিনা ঘাট পাড় থেকে নৌকায় শীতলক্ষ্যা নদী পার হলেই জমিদার বাড়ি।
সময় জার্নাল/এমআই