মাইদুল ইসলাম:
বিজয়ের ৫২ বছর। আজ বাঙালির বিজয়ের দিন। ষোলোই ডিসেম্বর তারিখটা বাংলাদেশের তথা বাঙালির মনে চিরতরে মুদ্রিত হয়ে গেছে। আজকের এদিনে শুনবো দেশকে স্বাধীন করতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আনোয়ার হোসেনের (বীরপ্রতীক) মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। এক সকালে তার বাড়িতে বসে দীর্ঘ আলাপ চলে একাত্তরের জানা-অজানা প্রসঙ্গে। আলাপচারিতায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জানান ১৬ ডিসেম্বর তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। এমন দিন আর জীবনে আসেনি বললেন বাংলার এই সূর্য সন্তান।
১৬ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় তারা দেখতে পান ভারতীয় বাহিনীর ১৫-২০ টি হেলিকপ্টার ঢাকার দিকে আসতেছেন। এরপর তারা নিশ্চিত হন হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবেন। তারা যেহেতু গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন, সেদিন তারা ঢাকার আশেপাশেই অবস্থান করছিলেন। এরপর তারা সাথী মুক্তিযোদ্ধারা সদলবলে অস্ত্রসস্ত্রসহ ঢাকায় আসেন এবং গুলশানে ক্যাম্প করেন। এরপর তারা সেদিনটি উদযাপন করেন। এমনকি সেদিন তারা খাওয়াদাওয়া করার কথাও ভুলে যান বিজয়ের আনন্দে। এরপর সেখান থেকে তারা আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করাসহ বিভিন্ন জায়গায় যান। সে বিজয়ের দিনটি আজও এই বীরের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। তিনি বলেন, সেই বিজয়ের দিনের আনন্দ, এত আনন্দ আর কখনো পাননি।
বীর প্রতীক মো: আনোয়ার হোসেন জানান, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তারা জানতে পারেন পাক-হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। তবে কোন তারিখে আত্মসমর্পণ করবে সে তারিখ নির্ধারণ হয়নি। ৬ ডিসেম্বর এরপর আত্মসমর্পণ এর গুঞ্জন আরও বাড়ে এবং ১০ ডিসেম্বর এর পরে তারা জানতে পারেন ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে পারে পাকিস্তানি বাহিনী।
তিনি ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। আত্মসমর্পণের কথা শুনলেও, আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর সকালে নিশ্চিত হওয়ার পর তারা যুদ্ধ বন্ধ করেন।
যুদ্ধের সময়ে তার স্বরণীয় অপারেশনের কথা জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, আমাদের সব অপারেশনই স্বরণীয় হয়ে আছে। তবে আজও স্মৃতিপটে বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে একটি অপারেশন। আমার বিভিন্ন অপারেশন এর মধ্যে অন্যতম ও পুরো বাংলাদেশের যুদ্ধের অনুপ্রেরণা হয়ে দাড়ায় পূর্ব বাংলার সাবেক গভর্নর কুখ্যাত রাজাকার আবদুল মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে অপারেশন। যিনি রাজাকারদের মূল নিয়ন্ত্রক ও বুদ্ধিদাতা। আমাদের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল হায়দার সাহেবের কাছ থেকে পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মোনায়েম খানকে হত্যার এ বিশেষ অপারেশন নিয়ে এসেছিলাম আমি। এরপর মোনায়েম খানের বাড়িতে আমরা অপারেশন করার জন্য রিকি করতে থাকি। এবং তার বাড়ির কাজের লোকদের সাথে কথা বলে তাদের যুদ্ধের একটি অংশ করে আমরা তাদের সহযোগীতা নিয়েই অপারেশনটির তারিখ ঠিক করি। তখন আমি একটি চটের ব্যাগ নিয়ে বাজারের মত করে সেটায় আমার স্ট্যান গান, একটা পি ফোর বোম, এইট থার্টিসিক্স গ্রেনেড নিয়ে লুঙ্গি আর শার্ট পরে বনানী আসি এবং সাথী যোদ্ধা মোজাম্মেলের সাথে আলাপ আলোচনা করে আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তার ড্রয়িং রুমে উঠে আমি তাকে স্টেনগান দিয়ে গুলি করি, মোনায়েম খান সামনের দিকে উপুড় হয়ে পড়ে যায় এবং সে গুলি খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেলে আমি পিছন দিকে ফিরে আসি। এবং মোজাম্মেল তখন গ্রেনেড চার্জ করে। তবে গ্রেনেডটি তখন বিস্ফোরণ হয়নি। পরবর্তীতে এটি তার বারান্দায় পাওয়া যায়। এভাবে আমরা আমাদের এই অপারেশনটা সফল করি। তখন আমাদের এই অপারেশনটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ছাড়াও পুরো বিশ্বে আলোচিত হয়৷ এবং এরপরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা অনেক এগিয়ে যায়।
আব্দুল কাদির ও জহুরা খাতুনের দ্বিতীয় ও প্রথম পুত্র সন্তান আনোয়ার। বাবা ঠিকাদারি করতেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডে। আদি থেকেই তাদের বাস গুলশান থানাধীন কালাচাঁদপুরে।
লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কালাচাঁদপুর প্রাইমারি স্কুলে। স্কুলটি পরে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত হয়। এরপর অষ্টম শ্রেণিতে তিনি ভর্তি হন তেজগাঁও পলিটেকনিক হাই স্কুলে। এসএসসি পাশ করেন ১৯৭০ সালে, ফার্স্ট ডিভিশন পান বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। অতঃপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন তিতুমীর কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র।
এমআই