শাকিল আহমেদ:
বাংলাদেশ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি ৭৬ বছরে পদার্পন করেছে। দীর্ঘ এ সময়ে ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সত্তর এর নির্বাচন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ এবং জিয়া সরকারের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছিল দূর্বার।
ছাত্রলীগ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটঃ
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস গ্রন্থে ডঃ মোঃ হান্নান লিখেছেন, "ভাষা প্রশ্নে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এক ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করতে থাকলে সংগঠনের বিদ্রোহী অংশ শুধুমাত্র ‘নিখিল শব্দটি বাদ দিয়ে 'পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে একটি ভিন্ন আহবায়ক কমিটি গঠন করে।' ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি এই বিদ্রোহী ছাত্রলীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল মিলনায়তনে নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে বিদ্রোহী ছাত্রলীগ কর্মীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রনেতা অলি আহাদ সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন। 'তিনি লিখেছেন- 'সম্মেলনে নইমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী) কেন্দ্রীয় কমিটির আহবায়ক এবং অলি আহাদ ঢাকা শহর শাখার ছাত্রলীগের আহবায়ক নির্বাচিত হন। তবে পুনর্গঠিত এই নয়া আন্দোলন ছাত্রলীগ গঠনে মূল উদ্যোগ গ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।"
ছাত্রলীগের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসঃ
আওয়ামীলীগ সৃষ্টির প্রায় দেড় বছর আগে ছাত্রলীগের জন্ম। শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, ‘আওয়ামী লীগ গড়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরত। ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের নেতাকর্মীদের অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠানকে খতম করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করে নাই।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা নং- ২৩৬)।
ছাত্রলীগের চলার পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। সবচেয়ে বড় আন্দোলন গড়ে ওঠে ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে। শুধুমাত্র বিরোধী দলসমূহ নয়, আওয়ামীলীগের মধ্যে অনেকেই ৬ দফার বিরোধিতা করেন। এই দুঃসময়ে ৬ দফা আন্দোলন বেগবান করতে ভূমিকা রাখে ছাত্রলীগ। যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, ছাত্রলীগ সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এতে নেতৃত্ব দেন। তাদের পরামর্শে আওয়ামী লীগ ছয় দফার পক্ষে হরতাল আহ্বান করে ৭ জুন। এর আগে, ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে শিক্ষা আন্দোলন সফল করলেও এবার ছাত্র ইউনিয়ন নীরব ভূমিকা পালন করে।
১৬৬৯ সালে ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে ছাত্র গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তৎকালীন ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভ্যানগার্ড হিসেবে ছাত্রলীগ কাজ করত। একাত্তরে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের প্রায় ১৭ হাজার নেতা-কর্মী শহীদ হন। সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ১০ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ১/১১’র সময় শেখ হাসিনাসহ ছাত্র-শিক্ষক সবার মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল। যার ধারবাহিকতায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সকল রাজবন্দি মুক্তি পেয়ে ২০০৮ সালে একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের শুরু হয়। এইতো সেদিনও আমরা দেখেছি করোনা মহামারীতে ছাত্রলীগ কর্মীদের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা। গনতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার আন্দোলনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ছাত্রলীগ সরব ভূমিকা পালন করছে।
ইতিহাস-ঐতিহ্য ও গৌরব-সংগ্রামে ছাত্রলীগ অনন্য। বাংলাদেশের যেকোনো সংকটে ছাত্রলীগই সর্বপ্রথম এগিয়ে এসেছে। অন্যায়-অবিচার প্রতিহত করে ভূমিকা রেখেছে দেশ ও জাতি গঠনে। বাঙালি জাতির সকল সমস্যা, সংকটে ছাত্রলীগ তার স্বীয় আদর্শে উজ্জীবিত হয়েই আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে বলে বিশ্বাস করি।
সময় জার্নাল/এলআর