আলী আজীম, মোংলা (বাগেরহাট):
প্রথম দিকে আমার নারকেলের ছোবড়ার ব্যবসা ছিল। নারকেলের ছোবড়ার বিভিন্ন পন্য তৈরি করে দেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করতাম। সম্প্রতি নারকেলের ফলন কমে যাওয়ায় কাঁচামালের সমস্যা দেখা দেয়। অনেক কর্মচারী, বড় প্রতিষ্ঠান এসব টিকিয়ে রাখতে নতুন পন্য ও কাস্টোমার খুজতে লাগলাম।
একটি প্রতিষ্ঠান পেলাম যারা পরিবেশ বান্ধব পন্য বাজারজাত করে। প্রথম দিকে তারা আমাকে কাঠের তৈরি ৪০ হাজার পিস বেবি ব্যালান্স বাইকের চাহিদা দিল। স্যাম্পল অনুযায়ী কাঠ থেকে বাইক তৈরি করে দিলাম, তারাও পছন্দ করল। ইতোমধ্যে ২০ হাজার পিস বাইক পাঠানো হয়েছে, আরও ২০ হাজার পিস বাইক তৈরি হচ্ছে কারখানায়। এভাবেই কাঠের সাইকেল তৈরি ও রপ্তানির গল্প বলছিলেন ন্যাচারাল ফাইবারের উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদ।
এক সময় বাগেরহাটে শতাধিক নারকেল তেলের ফ্যাক্টরী ছিল। এসব কারখানায় তৈরি নারকেল তেল যেযত সারাদেশে। বাগেরহাট শহরের বাসিন্দা মোস্তাফিজ আহমেদের পরিবারও নারকেল তেলে ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন।ভেতরের শ্বাস দিয়ে তেল তৈরি হলেও, উপরের ছোবড়া নিয়ে বিপাকে ছিলেন ব্যবসায়ীরা।মোস্তাফিজ ফেলনা ছোবড়া দিয়ে নতুন পন্য তৈরির চিন্তা করেন।
সেই ভাবনা থেকে ২০০২ সালে আঁশ দিয়ে যন্ত্রে তৈরি তোশকের (ম্যাট্রেস) ভেতরের অংশ, কয়ার ফেল্ট তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। ২০০৫ সালে বাগেরহাট বিসিকে স্থাপিত সেই কারখানা উৎপাদনে যায়। ম্যাট্রেস ছাড়াও কয়ার ফেল্ট, কোকো পিট, ডিসপোজেবল স্লিপারসহ ছোবড়ার নানা পন্য তৈরি হতে করতে থাকেন। দেশ ও বিদেশে সমানভাবে চলতে থাকে তার এই পরিবেশ বান্ধব পন্য।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে নারকেলের ফলন কমে যাওয়া এবং ডাব বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়ায়। সংকট থেকে তৈরি হয় সম্ভাবনা, সেই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে নতুন পরিবেশ বান্ধব পন্য তৈরির চেষ্টা করতে থাকেন।গ্রিসের ‘কোক-ম্যাট’ (COCO-MAT) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী কাঠ দিয়ে সাইকেল তৈরির কারখানা স্থাপন করেন মোস্তাফিজ আহমেদ ও তার ভাই মোজাহিদ আহমেদ।বিসিক শিল্প নগরীতে স্থাপিত এই ফ্যাক্টরীতে এখন নিয়মিত-অনিয়মিত ৯০ থেকে ১২০ শ্রমিক কাজ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে কাজ।
কেই কাঠ সাইজ করছে, কেউ আবার সাইজ করা কাঠ সমান করার কাজ করছে। কেউ তৈরি করছেন চাকা, কেউ তৈরি করছেন হ্যান্ডেল, আবার কেউ তৈরি করছেন সাইকেলের ফ্রেম। সবশেষে শ্রমিকদের নিপুন হাতে কাঠের বাইকে নানান রং ও পালিশ করা হচ্ছে।গেল ৬মাস ধরে এই কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় নিয়মিত-অনিয়মিত ১২০ জন শ্রমিক।প্রতিদিন এই কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে প্রায় ৩০টি বাইক।বিদেশে রপ্তানি করা পন্য নির্মানের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে খুশি শ্রমিকরা।
কারখানার শ্রমিক শিল্পী রানি সরকার বলেন, রাজমিস্ত্রী স্বামীর আয়ে দুই মেয়ের লেখাপড়া করাতে পারছিলাম না। এক বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে সাইকেল ফিটিংস এর কাজ করছি। মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। এই আয়ে মেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের চাহিদা পূরণ হচ্ছে।
সাইকেল তৈরিতে ব্যস্ত কারিগর শরিফুল তরফদার বলেন, সাইকেলটি তৈরি করতে ১১ টি আলাদা অংশের প্রয়োজন হয়। কারখানার বিভিন্ন স্থানে এসব অংশ তৈরি করে ফিটিংস করেন তারা। তারপরে রং করে প্রস্তুত করা হয়। একটা সাইকেল বানাতে গড়ে ৭-৮ ঘন্টা সময় লাগে।
কারখানার ব্যবস্থাপক আয়াস মাহমুদ রাসেল বলেন, চারটি প্রকল্পে শ্রমিকরা কাজ করছে। আমরা শুধু দক্ষ শ্রমিক-ই কাজে নিই বিষয়টি এমন নয়। কাজ শেখার প্রতি আগ্রহ থাকলে অদক্ষ শ্রমিকদের হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। এছাড়া আমাদের আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে।
এই পন্য কিভাবে মার্কেটিং করা হয় অথবা কিভাবে ক্রেতা খুজে পান এমন প্রশ্নে উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদের ছোট ভাই মোজাহিদ আহমেদ বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আমরা আমাদের নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেই। সেখান থেকেই মূলত ক্রেতারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন।
পন্যের দাম সম্পর্কে মোজাহিদ বলেন, প্রতিটি বেবি ব্যালান্স বাই সাইকেল ১৮ ইউরো, কাঠের বিশেষ চেয়ার- ১৭ থেকে ১৮ ইউরো, সান বেড ৫০ ইউরো এবং হোটেল বেড- ৫০ থেকে ৬০ ইউরোতে বিক্রি করা হয়।
কাঠের সাইকেল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসলেও, কিছু সংকটের কথা জানালেন, মূল উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদ। তিনি বলেন, রপ্তানির জন্য সরকার আমাদেরকে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিতো। সম্প্রতি তা কমিয়ে দিয়েছে। প্রণোদনা কমিয়ে দিলে বাজারে টিকে থাকা মুশকিল হবে।
এছাড়া নারকেলের ছোবড়া বা কাঠের কোন পণ্য রপ্তানির করতে হলে ফাইটোস্যানিটারী সার্টিফিকেট লাগে। ওই দপ্তরের অসহযোগিতাসহ পরিবেশ অধিদপ্তর এবং দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজেও বেশ বেগ পেতে হয় আমাদের। ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে এ ধরণের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরকারের যদি কিছু সহযোগীতা থাকে তা হলে খুব তাড়াতাড়ি এই বাজারগুলি ধরতে পারবেন বলে জানান তিনি।
গ্রীসের কোকো মাট কোম্পানির প্রজেক্ট ইনচার্জ মিস এভা বলেন, বাংলাদেশে তৈরি এই কাঠেছর বাইক বিশ্বের সেরা বাইক। এটা একদম স্থানীয় পন্য দিয়ে তৈরি হয়। এই বাইকের বেশ চাহিদা রয়েছে গ্রীসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ন্যাচারাল ফাইবারের সাথে ব্যবসা আরও সম্প্রসারণ করার কথা জানালেন তিনি।
সময় জার্নাল/এলআর