মোঃ জনি মিয়া:
বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের বীজ মন্ত্র ভাষা আন্দোলন ।ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে বাংলার স্বাধীনতা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ও সার্থক গণআন্দোলন হলো ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই চার বছরের ভাষা আন্দোলনে রক্তক্ষয়ী পরিণতির মধ্য দিয়ে পাকিস্তান শাসকগোষ্টী পূর্ববাংলার মানুষের ভাষার অধিকার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ২৮ বছরের তরুণ, উদ্দীপ্ত ছাত্রনেতা। এই সময় তিনি কেবল ভাষার অধিকার নয় পূর্ববাংলার স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা আন্দোলন ও জনমত তৈরিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন। তিনি কোনো একক আন্দোলন নিয়ে থাকেননি, সকল ন্যায়সঙ্গত ও পূর্ববাংলার মানুষের অধিকারসংশ্লিষ্ট সব ধরনের আন্দোলনে সক্রিয় এবং নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রাখেন।
যার ধারাবাহিকতায় এই তরুণ ছাত্রনেতার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই পরবর্তীকালে (১৯৭১ সালে) রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সূর্য উদিত হয়। চল্লিশের দশকের শেষ দিকেই শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ববাংলার জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার বিষয়টি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চোখ এড়িয়ে যায়নি, যে কারণে আরও অনেক প্রবীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে থাকলেও পাকিস্তানি গোয়েন্দা তখন শেখ মুজিবকেই নজরদারিতে রেখেছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৮-৫২ এই সময়টা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা আন্দোলনের কারণে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে এই সময় তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান নিজের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়নের যে রাজনীতি পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে শুরু করে তার বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ এই সময় থেকেই সচেতন ও অধিকার আদায়ে আন্দোলনমুখী হতে শুরু করে।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ— জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু আমরা জানি ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতির কাজ। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও দেশগঠনের কারিগর বঙ্গবন্ধুর সমস্ত অবদানকে খাটো ও বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস জ্বলে ওঠে আপন আলোয়। আমাদের সামনে এখন ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বঙ্গবন্ধুর দুখণ্ডে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার ভূয়সী প্রসংশা করে তাঁর নেতৃত্বের ঋণস্বীকার করেছেন অধিকাংশ ভাষাসৈনিকেরা। সম্প্রতি সেসব তথ্যকে আরও অকাট্য করেছে উল্লিখিত ঐতিহাসিক দলিলসমূহ।
বঙ্গবন্ধু কীভাবে ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন, এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মুনতাসীর মামুন রচিত ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’ গ্রন্থ থেকে জানতে পারি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে আরও অনেকের সাথে অন্নদাশঙ্কর রায় ঢাকা আসেন। কথা হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। অন্নদাশঙ্কর রায় লেখেন: ‘‘শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটি প্রথম কবে আপনার মাথায় এল?’ ‘শুনবেন?’ তিনি (বঙ্গবন্ধু) মুচকি হেসে বললেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সক্রিয়তায় প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।
২৬ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে দলে দলে এ সমাবেশে যোগদান করেন। এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এই সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সভায় গণপরিষদ সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষা-বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলোর সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান দুজন করে প্রতিনিধি দান করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এই ধর্মঘট সফল করতে ১ মার্চ, ১৯৪৮ তারিখে প্রচার মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম (তমদ্দুন মজলিস সম্পাদক), শেখ মুজিবুর রহমান (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য), নঈমুদ্দীন আহমদ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক) এবং আবদুর রহমান চৌধুরী (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা) জাতীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে এ বিবৃতির গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত এই ধর্মঘটটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সফল ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন।
দিনটি নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শাসমুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আবদুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়।’ [কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, পৃ ২০৬]
শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৬ এপ্রিল গোপালগঞ্জে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। এ নিয়ে ৩ এপ্রিল গোয়েন্দাদের দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ মার্চ গোপালগঞ্জে প্রায় চারশ ছাত্র বিক্ষোভ করে। তারা সেই বিক্ষোভ থেকে ১৬ তারিখে শহরে দিনব্যাপী হরতাল ডাকে। তারা শেখ মুজিবুরের মুক্তির দাবিতে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্লোগান দেয়।
১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তার দীর্ঘ বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়।’ জিন্নাহার বক্তৃতার কয়েকদিন পর ফজলুল হক হলের সামনে একজন ছাত্রনেতা উর্দুভাষার পক্ষে বক্তৃতা দিলে শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র প্রতিবাদ করেন । রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে লাগলো। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যাঁরা নিরলস কাজ করেছেন সেই সব ছাত্রনেতার মধ্যে মুজিব ছিলেন অন্যতম। শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দুবার গ্রেপ্তার হন।
ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ‘জুলুম প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা হয়। ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি এই কমিটির উদ্যোগে প্রতিরোধ কর্মসূচি ও ছাত্রসমাবেশ ডাকা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ছাত্রসভায় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নাইমউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন। ফলে এ সংগ্রামে শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসে নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। ভাষাসৈনিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন: শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।’[তথ্যসূত্র : ভালোবাসি মাতৃভাষা- পৃষ্ঠা: ৬২]
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা সফরকালে পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গে প্রতিরোধের ঝড় ওঠে। বন্দি অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের আলোচনা হয় পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।
আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে।
এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১শে ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২শে ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিটি ১৯৫২ সালের ২৯ জুন সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়।
২৭ এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত এক পর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লিখা ভাষণ পাঠ করেন কমরুদ্দীন আহমদ। ওই প্রতিনিধিত্ব সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল। সে দিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণের পর ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন।বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ভাষাকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
প্রভাষক , ইংরেজি বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।