অ আ আবীর আকাশ, লক্ষ্মীপুর
অপচনশীল প্লাস্টিকের কাছে দিনকে দিন মুখথুবড়ে পড়েছে বাঁশ শিল্প। গিলে খাচ্ছে বাঁশ শিল্পের শত শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন বাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার কারিগররা। আগে লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন হাটবাজারে চোখে পড়তো অনেকাংশ জুড়ে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসতে। ক্রমান্বয়ে প্লাস্টিকের বিষাক্ত ছোবলে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। যা এখন আর হাটে বাজারে তেমন চোখে পড়ে না।
গ্রামীণ জনপদে বাঁশ শিল্প এখন তেমন নেই বললেই চলে। বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় এর থেকে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের দাম দিনদিন বাড়ছে। তাই বাঁশের তৈরি পণ্যের কদরও কমে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জে। ফলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ রায়পুর রামগতি কমলনগর ও সদর উপজেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক নারীপুরুষ কারিগরদের ভাগ্যে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন।
প্লাস্টিকের সহজলভ্যতার কারণে অন্যদিকে বাঁশের দাম বেশি হওয়ায় বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যাওয়ার কারনে মানুষ বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রের উপর ক্রমশ আগ্রহ হারানোর হারায়। এতে প্লাস্টিকের বিষাক্ত ছোবলে ঝুঁকে যাওয়ায় বাঁশ শিল্প চরম সংকটে রয়েছে।
আগে বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে মানুষ গৃহস্থালি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে ও বাঁশের তৈরি সরঞ্জামাদি ব্যবহার করত। কালের বিবর্তনে আধুনিক জীবনধারায় প্লাস্টিকের ব্যবহার ও দিনদিন বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা এখন বিলুপ্তির পথে। কালের বিবর্তনে বাঁশের তৈরি পণ্য এখন আর আগের মতো চোখেও পড়ে না।
বাঁশের মূল্য বৃদ্ধি আর অপ্রতুল ব্যবহারের কারণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প আজ হুমকির মুখে। আজ থেকে ১৪-১৫ বছর আগেও বাঁশের তৈরি সামগ্রী বাচ্চাদের দোলনা, পাখা, কুলা, চালনীসহ বিভিন্ন প্রকার আসবাবপত্র গ্রামঞ্চলে বিস্তার ছিল। কিন্তু এখন এর কদর নেই বললেই চলে ।
যে বাঁশ আগে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই বাঁশ বর্তমান বাজারে কিনতে হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। বাঁশের দাম যেমন বেড়েছে সেই পরিমাণ বাড়েনি এসব পণ্যের দাম। চাহিদা অনুযায়ী বাঁশের উৎপাদন কম থাকার কারণে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ ঘর বাড়ি নির্মাণে প্রয়োজন মতো বাঁশ বৃদ্ধি হচ্ছে না।
সদর উপজেলার উপশহর ঐতিহ্যবাহ দালাল বাজারে বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি করতে আসা সাদ্দার পুল এলাকার আবদুর রহমান (৪৭) জানায়, তাদের গ্রামে বেশকয়েকটি পরিবার এ কাজে নিয়োজিত আছে। অতি কষ্টে বাঁশ শিল্প টিকিয়ে রাখতে ধার-দেনা ও বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে কোনোরকম জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন তারা।
বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছেন, গ্রামীণ জনপদে বাঁশ ছিল একটি ঐতিহ্য। প্রতি বাড়িতে কমবেশি চাষ হতো বাঁশ। যা দিয়ে তৈরি হতো নিত্যদিনের গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত সকল ধরনের জিনিসপত্র। তবে এখনো মাঝেমধ্যে গ্রামীণ উৎসব ও মেলাগুলোতে বাঁশ ও শিল্পীদের তৈরি খোল, চাটাই, খলুই, ধামা, টোনা, পাল্লা, মোড়া, বাইর, পাতি, খাঁচা, উন্যা, চালুইন, হাজি, হুরা, ওড়া, টুকরি, আধলাই, লাই, আনতা, ছাই, হারল, চোখে পড়ে।
উপজেলার প্রতিটি গ্রামে কম বেশি অনেক পরিবার এ পেশায় সম্পৃক্ত ছিল। বাঁশ-বেত দিয়ে তারা তৈরি করত গৃহস্থালি ও সৌখিন নানা পণ্যসামগ্রী। তা দেখতে অনেকটা আকর্ষণীয় ছিল। এসব বিক্রি করেই চলত গ্রামগঞ্জের এসব মানুষের জীবনযাপন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাঁশের দাম বৃদ্ধি, খরচের তুলনায় লাভ কম ও দিনদিন চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্ষুদ্র এ শিল্পের কারিগরদের অধিকাংশই এখন আদি পেশা বদল করে কৃষিসহ নানা পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
উপজেলার রাখালিয়া বাজার ও জকসিন বাজারে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করতে আসা কারিগর রহমান (৩৫) বলেন, বিভিন্ন সমিতি থেকে বেশি সুদ দিয়ে টাকা নিয়ে কোনো রকমে টিকে আছেন তিনি। এ শিল্পটির উন্নতির জন্য সরকারিভাবে যদি অল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয় তাহলে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
বিসিক শিল্প নগরী লক্ষ্মীপুরের উপ-ব্যবস্থাপক আসাদুল্লাহ হাসান সাংবাদিক অ আ আবীর আকাশকে বলেন বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সহ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা দ্রুত সময়ের মধ্যে করে দেয়ার চেষ্টা করা হবে।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক ড. মো.জাকির হোসেন অ আ আবীর আকাশকে বলেন, ‘বাঁশ শিল্পের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য বেশি বেশি বাঁশ চাষ করতে হবে। যেহেতু এটি একটি অর্গানিক প্রোডাক্ট। বিভিন্ন কুটির শিল্পে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র সংরক্ষণ করে এ শিল্পকে ধরে রাখতে হবে। এছাড়া প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বর্জন করতে হবে। তাহলে বিভিন্ন প্রকার রোগবালাই থেকে মানুষ রেহাই পাবে। বাঁশের তৈরি পণ্যের কদরও বাড়বে।’
এমআই